৯পৃষ্ঠা ভূমিকা সংবলিত ‘গোরা’ (১৯১০), সমগ্র ভারতীয় সাহিত্যে একটি যুগান্তকারী উপন্যাস। একে ইউরোপীয় বঢ়রপ হড়াবষ-এর সঙ্গে তুলনা করা চলে। আকার-আকৃতি, ভাব ও আদর্শে ‘গোরা’ মহাকাব্যের মতো বিশাল, একটা জাতির সংকটের কাহিনি। এ উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথ সমাজ, দেশ তথা সমগ্র ভারতবর্ষের নানা সমস্যা ও সংকটকে রূপদান করার চেষ্টা করেছেন। গোরা রচনার প্রাক্কালে তৎকালিন সমাজের মধ্যেও ছিল নানাপ্রকার সংস্কার-আন্দোলন সম্পর্কে ব্রাহ্মসম্প্রদায়ের নিজেদের মধ্যকার মতভেদ, তারা হিন্দু কি-না এ নিয়ে দ্বন্দ্ব, হিন্দুদের সঙ্গে ব্রাহ্মণদের বিবাদ, পুনরুত্থানবাদী হিন্দুদের মধ্যে হিন্দু ধর্মের সবকিছুকে মহৎ বলে নির্দ্বিধায় গ্রহণ করার চেষ্টা। ‘গোঁড়া হিন্দু পুনরুত্থানবাদ, ব্রাহ্মধর্মের আন্দোলন, স্বাদেশিকতা ও উপন্যাস প্রাণচাঞ্চল্যের ব্যাপকতা এনেছে। এ উপন্যাসের ঘটনাবিন্যাস বৈচিত্র্যপূর্ণ। কৃষ্ণদয়ালবাবুর সন্তান গোরা আসলে আইরিশ সন্তান। সিপাহী বিদ্রোহের সময়ে তার জন্ম এবং জন্মের পর তার মা মারা গেলে সে কৃষ্ণদয়ালবাবুর সন্তান হিসেবেই বড় হয়ে ওঠে। সে যেন বিশ শতকের গোড়ার দিকে গোটা ভারতবর্ষের প্রতিভূ। এ উপন্যাসের অন্যান্য চরিত্রÑ বিনয়, পরেশবাবু, হারান, সুচরিতা, ললিতা, আনন্দময়ী সকলেরই প্রধান আগ্রহ মতবাদ প্রতিষ্ঠার। এ উপন্যাসের প্রথম দিকে গোরা স্বদেশপ্রেমই জীবনের স্বার্থকতা মনে করলেও পরবর্তী সময়ে সে জেনেছে স্বদেশপ্রেম ও রোমান্টিক ব্যক্তিপ্রেম পরস্পর পরস্পরের পরিপূরক। অবশেষে সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে- ‘‘ যে আমারই তাহাকে আমি লইব। নহিলে পৃথিবীতে আমি অসম্পূর্ণ- আমি ব্যর্থ হইয়া যাইব।’’ আর এই উপলব্দিতেই গোরার নবজন্ম। তাই ‘গোরা’ মহৎ উপন্যাস। চরিত্রনির্ভর জীবনধর্মী উপন্যাস।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম ১৮৬১ সালের ৭ মে (২৫ বৈশাখ ১২৬৮) কলকাতার জোড়াসাঁকোয়। বাবা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ। বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ ভারতীয় মনীষী এবং বিশ্ববিখ্যাত কবি। ছাপার অক্ষরে স্বনামে তাঁর প্রথম প্রকাশিত কবিতা ‘হিন্দু মেলার উপহার’ (৩০.১০.১২৮১ ব.)।
১৮ বছর বয়সের মধ্যে তিনি ‘বনফুল’, ‘কবিকাহিনী’, ‘ভানুসিংহের পদাবলী’, ‘শৈশব সংগীত’ ও ‘রুদ্রচণ্ডু’ রচনা করেন। ‘জ্ঞানাঙ্কুর’ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘ভুবনমোহিনী প্রতিভা’ তাঁর প্রথম গদ্য প্রবন্ধ। ‘ভারতী’র প্রথম সংখ্যায় তাঁর প্রথম ছোটগল্প ‘ভিখারিণী’ এবং প্রথম উপন্যাস ‘করুণা’ প্রকাশিত হয়। ২২ বছর বয়সে নিজেদের জমিদারি সেরেস্তার এক কর্মচারীর একাদশবর্ষীয়া কন্যা ভবতারিণীর (পরিবর্তিত নাম মৃণালিনী) সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয় (৯.১২.১৮৮৩)। পুত্র রথীন্দ্রনাথের শিক্ষা-সমস্যা থেকেই কবির বোলপুর ব্রহ্মচর্য আশ্রমের সৃষ্টি হয় (২২.১২.১৯০১)। সেই প্রতিষ্ঠানই আজ ‘বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়’-এ রূপান্তরিত হয়েছে।
১৯১২ সালের নভেম্বর মাসে গীতাঞ্জলির ইংরেজি অনুবাদ বা ‘ঝড়হম ঙভভবৎরহমং’ প্রকাশিত হয়। ১৯১৩ সালের অক্টোবরে প্রথম ভারতবাসী রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডক্টরেট (১৯১৪) এবং সরকার স্যার (১৯১৫) উপাধিতে ভূষিত করে।
রবীন্দ্রনাথের একক চেষ্টায় বাংলাভাষা সকল দিকে যৌবনপ্রাপ্ত হয়ে বিশ্বের দরবারে সগৌরবে নিজের আসন প্রতিষ্ঠা করেছে। কাব্য, ছোটগল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ, গান প্রত্যেক বিভাগেই তাঁর অবদান অজস্র এবং অপূর্ব। তিনি একাধারে কবি, দার্শনিক, শিক্ষাবিদ, সুরকার, নাট্যপ্রযোজক এবং স্বদেশপ্রেমিক। তাঁর রচিত দুই হাজারের ওপর গানের স্বরলিপি আজো প্রকাশিত হচ্ছে। দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের (ভারত ও বাংলাদেশ) জাতীয় সংগীত-রচয়িতারূপে একমাত্র রবীন্দ্রনাথেরই নাম পাওয়া যায়।