লেখকের কথা এক সাগর রক্তের বিনিময়ে তুমি স্বাধীনতা, লাখো শহীদের জীবনের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা তুমি অবিনাশী অজেয় বাসনা। বাঙালি জাতীর চেতনায় সদা জাগ্রত সুভাসিত প্রেম। আমরা বাংলা মায়ের সর্ব শ্রেণীর মানুষ যারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছি তাদের লালিত স্বপ্নপূরণ- রক্তে লেখা একটি নাম স্বাধীন বাংলাদেশ। লাখো মায়ের অশ্র“জল, কোটি কোটি মানুষের রণাঙ্গনের হুঙ্কার, লাখো কোটি অগ্রজ ও অনুজের ধৈর্যের ফসল স্বাধীনতা। স্বাধীনতা তুমি নির্মল বাতাস, পাখির গানে বাউলের মাখা মাখা কণ্ঠস্বর। স্বাধীনতা তোমার পরিণতি নদীর উত্তাল তরঙ্গে, ঢেউয়ের বাঁকে বাঁকে, শিশুর মানিক জোড়া দুটি দাঁতের ফাঁকে নির্মল হাসিতে এবং বাঙালি জীবনের প্রতি পরতে পরতে বিরাজমান অনুমেয়। প্রিয় স্বাধীনতা! তোমাকে অনভ্যাস স্পর্শ করে মায়ের আঁচলে লুকানোর স্বাদ পাই, আনন্দে মন উদ্বেলিত হয়ে ওঠে। তুমি এতো শান্ত তুমি এতো প্রিয়, তুমি এতো মধুর- তুমি এতো গর্বের- তুমি এতো আদরের তুমি কোমলে-কঠিনে প্রজ্বলিত। কিন্তু একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আজ ভাবতে অবাক লাগে স্বাধীন বাংলাদেশে এতো হাহাকার কেন? কেন এতো নিষ্ঠুরতা, বর্বরোচিত আদিম উন্মাদনা! হাজারও অশনি সংকেতে আমাদের নিয়ত দহন করে যাচ্ছে। এ যেনো অভিশাপ লোভ লালসা আর মোহাচ্ছন্নতার বিষবাষ্পে ধুমায়িত দেশ। সচেতন মানুষ কিংবা মুক্তিযোদ্ধাদের জীবদ্দশায় তা, দেশ-মাটি-মানুষ কারও কাম্য হতে পারে না। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে গবির্ত ছন্দে বলি- স্বাধীনতা তোমাকে পেয়ে আমি ধন্য, তুমি আমার হৃদয়ে তুমি আমার মননে ‘একাত্তুরের অবিনাশী স্বৃতি’ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের- বাস্তব চিত্রগুলো দুর্বল লেখনির মাধ্যমে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছি মাত্র। এতে ভুলত্র“টি থাকতে পারে- সকলের কাছে আগেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। আমার এই স্মৃতিচারণ তথ্যগুলো সংরক্ষণে মূল ভূমিকা রেখেছে আমার সন্তান তুল্য, অতি আদরের স্নেহের মীর খোরশেদুল আলম তুষার। তার অক্লান্ত প্রচেষ্টা, মেধা, শ্রম, বিশেষ করে আমাকে দিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লিখে নেয়া এবং মুক্তিযুদ্ধের তথ্য সংগ্রহে তার যে নিরলস প্রচেষ্টা, আগ্রহ ও অবিচল আস্থা তা দেখে আমি নিজেকে আরেকবার গর্বিত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে মনে করি। একজন মুক্তিযোদ্ধাকে প্রকাশনার মাধ্যমে উপস্থাপন করে সমগ্র বাংলাদেশের রণাঙ্গনের আমার প্রিয় সাথী বীরমুক্তি যোদ্ধাদের সম্মানিত করা হয়েছে। আমি স্বাধীনতাকামী সকল মানুষের প্রতি স্বকৃতজ্ঞ। মহান মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক কাহিনী লিপিবদ্ধ করা অনেক কঠিন কাজ। আমার এই বাস্তব মুক্তিযুদ্ধ ভিক্তিক খণ্ড চিত্র পড়ে প্রকৃত ইতিহাস জানার ক্ষেত্রে অবদান রাখবে বলে আমার বিশ্বাস। বইটিতে মহান মুক্তিযুদ্ধে আমার অংশগ্রহণ এবং যুদ্ধের কিছু খণ্ড চিত্র আর ১৯৭১ সালে দুঃসহ জীবন গাঁথা একজন মুক্তিযোদ্ধার ব্যক্তিগত রচনাবলি প্রকাশিত হলো মাত্র। কিন্তু লাখো মুক্তিযোদ্ধা রণাঙ্গনে জীবন বাজী রেখে পাকসেনা বাহিনীদের পরাজিত করে বাংলাদেশের পতাকা বিশ্বের দরবারে উড়িয়েছে। আর তা বিশ্ববাসি শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে। তাই তো বীর মুক্তিযোদ্ধারা অতন্দ্র প্রহরী হয়ে বাংলা মাকে আগলে রেখেছে। কোম্পানি কমান্ডার সুধা ভাই, বন্ধু মতিউর রহমান, আমার সহধর্মিণী, কবি মৃধা আলাউদ্দিন ও তরুণ লেখক এনাম রেজা- যাদের প্রেরণা ও ভালোবাসায় আমার এ অব্যক্ত কথামালা ভাষায় প্রকাশ পেলো তাদের সবার কাছে আমি কৃতজ্ঞ।
মহসিন আলী রেজা — একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, মানবিক চেতনাসম্পন্ন চিন্তাশীল লেখক ও দেশপ্রেমিক সংগঠক। তাঁর জন্ম গাজীপুর জেলার এক সংগ্রামী বাস্তবতার আবর্তে, যেখানে মুক্তিযুদ্ধের শেকড় গভীরভাবে প্রোথিত। একাত্তরের রণাঙ্গনে সরাসরি অংশগ্রহণকারী এই মুক্তিযোদ্ধা দেশমাতৃকার স্বাধীনতা অর্জনে নিবেদিত ছিলেন প্রাণপণে। দেশপ্রেম, আত্মত্যাগ ও ইতিহাস সংরক্ষণের গভীর দায়বদ্ধতা থেকেই তিনি লিখেছেন মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক স্মৃতিকথা “অবিনাশী স্মৃতি” — যেখানে উঠে এসেছে রণাঙ্গনের খণ্ড খণ্ড জীবন্ত চিত্র, যুদ্ধকালীন অভিজ্ঞতা এবং মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাস্তবতায় একজন মুক্তিযোদ্ধার গভীর অনুভব। বইটি কেবল স্মৃতিচারণ নয়, এটি একটি প্রজন্মান্তরে অনুপ্রেরণার দলিল। তাঁর লেখায় যেমন আছে একাত্তরের গৌরবগাথা, তেমনি আছে স্বাধীন বাংলাদেশের নানা সামাজিক সংকট ও মূল্যবোধহীনতার প্রতি তীব্র প্রশ্ন। যুদ্ধকালীন সতীর্থদের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা, এবং নতুন প্রজন্মের লেখক ও সংগঠকদের প্রতি কৃতজ্ঞতাবোধ লেখক হিসেবে তাঁর উদার ও সংবেদনশীল চরিত্রের প্রতিচ্ছবি। মহসিন আলী রেজা — একাধারে একজন প্রত্যক্ষ ইতিহাসবাহক ও একজন নিবেদিত লেখক, যিনি কলমে তুলে আনেন একাত্তরের না-বলা কথা, এবং হৃদয়ে বহন করেন বাংলাদেশ নামক রক্তে লেখা একটি স্বপ্নের সৌরভ।