ভাষাপ্রেম ভাষাবিরোধ নিজের ভাষাকে ভালোবাসা মানুষের এক প্রাচীন সাংস্কৃতিক অভ্যাস, যা তার চৈতন্যে ওতপ্রোত হয়ে যায়। বলা বাহুল্য এই ভালোবাসার চেতনা সমস্ত ব্যক্তি বা ভাষাগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে সমান স্পষ্ট নয়, তীব্রও নয়। সমাজে ভাষাব্যবহারকারী সাধারণ মানুষের অধিকাংশই তার ভাষাটিকে যেমন জন্ম থেকে শিখেছে সে ভাবেই ব্যবহার করতে অভ্যস্ত। যে-সমাজে সাক্ষরতা আসেনি, যা কেবল মৌখিক কথাবার্তার সমাজ, সেই সঙ্গে যে-সমাজের সঙ্গে বাইরের অন্য কোনো ভাষাগোষ্ঠীর আদানপ্রদানের সম্পর্ক নেই—সে-সমাজে এই ভাষা সম্বন্ধে আত্মচেতনার অভাব আছে। ফলে ভারতের মতো অংশত নিরক্ষর দেশে আমরা অনেকেই নিজে কোন্ ভাষা বলি, এ ভাষার নাম কী—তা জানি না। যাঁরা মূলত বাংলাভাষী তাঁরাও কখনও কখনও নিজেদের গোষ্ঠীর নাম ধরে, তিনি বাংলার যে-রূপ বলেন তার নাম দেন ‘পলিয়া' বা 'মাল’ বা ‘রাজবংশী’। অল্পশিক্ষিত জনগণনা কর্মীরা এ নিয়ে বিচার বা প্রশ্ন করে না। তারা ওই নামটাই লিখে নেয়। ফলে ভারতে মানুষের বলা মাতৃভাষা কত, তার হিসেব করতে জনগণনা- কর্তারা হিমসিম খেয়ে যান। অনেক চালাচালি করে এবারের জনগণনায় ভারতে মোট ১১৪টি বৃহৎ মাতৃভাষা নির্ণয় করা হয়েছে। যে যা নাম বলছে সেই অনুযায়ী ভাষার সংখ্যা স্থির করলে তা দু হাজারের কম হত না। এতে বিচ্ছিন্নতাবাদী রাজনীতিকদের সুবিধে হত অবশ্যই, যেমন পশ্চিম বাংলার উত্তরাঞ্চলে কিছু চেষ্টা হয়েছে। ভাষার চরিত্র নিরক্ষর মানুষ বিচার করেন না, তাঁরা বহুক্ষেত্রে নিজেদের নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর নামটাকেই ভাষার নাম হিসেবেও ধরে নেন। তারই ফলে সমস্যা ঘটে।
পবিত্র সরকার নামক ঘটনাটির বর্ণনা করা খুব সহজ কাজ নয়। এক হল তাঁর শিক্ষাদীক্ষা ও অধ্যাপনার উজ্জ্বল র্জীবন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স ও এমএ-তে দু-বার প্রথম হওয়া, ফুলব্রাইট বৃত্তি পেয়ে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষাবিজ্ঞানে এমএ ও পিএইচ ডি করেছেন, যাদবপুরে পড়িয়েছেন প্রায় সাতাশ বছর, বিদেশে মিনেসোটা বিশ্ববিদ্যালয়ে দু-বছর, এবং এখনও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং নানা কলেজে এমএ-র ক্লাস নিয়ে অক্লান্ত থাকছেন। রবীন্দ্র-ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন সাত বছর, ছ-বছর পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য শিক্ষা সংসদের সহ-সভাপতি। লেখাতেও অক্লান্ত ও বহুমুখী। ভাষাবিজ্ঞান ও ব্যাকরণ, নাটক ও নাট্যতত্ত্ব, লোকসংস্কৃতি, ইংরেজি শিক্ষা, রম্যরচনা, শিশুদের জন্য ছড়া গল্প উপন্যাস রবীন্দ্রসংগীত, আত্মজীবনকথা—সব মিলিয়ে তার নিজের বই সত্তরের উপর, সম্পাদিত পঞ্চান্নটির মতো। গান তার প্রিয় ব্যসন। এক সময়ে নান্দীকারে অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশনায় অভিনয়ও করেছেন। পশ্চিমবঙ্গ এ ত্রিপুরা সরকারের একাধিক ভাষা-বিষয়ক কমিটি ও কমিশনের অধ্যক্ষ করেছেন। ‘মৃত্যু’ সম্বন্ধ লিখেছেন, কিন্তু এখনও দাপটে বেঁচে থাকার সাধনা করে যাচ্ছেন এই সতেজ মানুষটি।