"উপন্যাস সমগ্র – সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্" একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ যা বাংলাদেশের খ্যাতিমান কথাসাহিত্যিক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র রচিত প্রধান উপন্যাসগুলোকে একত্র করেছে। তাঁর লেখাগুলো বাংলা সাহিত্যে আধুনিক চিন্তাধারা, মনস্তত্ত্ব, এবং সামাজিক বাস্তবতার গভীর পর্যবেক্ষণের জন্য বিশেষভাবে প্রশংসিত।
এই সংকলনে সাধারণত নিচের উপন্যাসগুলো থাকে:
লালসালু (১৯৪৮)
এটি সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র সবচেয়ে বিখ্যাত উপন্যাস।
গল্পটি এক গ্রামীণ ধর্মগুরুর, যে ধর্মকে ব্যবহার করে সাধারণ মানুষকে ধোঁকা দেয়।
উপন্যাসটি ধর্মীয় ভণ্ডামি, গ্রামীণ সমাজের কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাসের প্রতিচ্ছবি।
প্রধান চরিত্র মজিদ এক সৎকাজের নামে ধর্মকে হাতিয়ার বানিয়ে ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করে।
চাঁদের অমাবস্যা (১৯৬০)
এটি একটি মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস।
মানুষের মানসিক দ্বন্দ্ব, অস্থিরতা, এবং আত্মপরিচয়ের সংকটকে ফুটিয়ে তোলে।
চরিত্ররা বাস্তবতা ও কল্পনার মাঝখানে দোদুল্যমান।
কাঁদো নদী কাঁদো (১৯৬৩)
এই উপন্যাসে উঠে আসে নদীভাঙনের শিকার মানুষদের জীবনের করুণ বাস্তবতা।
গ্রামীণ মানুষের দুর্দশা, ক্ষয়, এবং অস্তিত্ব সংকটের চিত্র আঁকা হয়েছে।
সূর্য দীঘল বাড়ি(অনেক সময় সংকলনে অন্তর্ভুক্ত থাকে)
এটি মূলত একটি চিত্রনাট্য হলেও উপন্যাসের মতো পাঠযোগ্য।
গ্রামীণ জীবনের কুসংস্কার, নারীর প্রতি সমাজের অবজ্ঞা, এবং বেঁচে থাকার সংগ্রাম চিত্রিত।
সারমর্ম:
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র উপন্যাস সমগ্র বাংলা সাহিত্যে এক গাঢ়, গম্ভীর ও বাস্তবধর্মী ধারা নিয়ে আসে। তাঁর প্রতিটি উপন্যাসে রয়েছে—
মানুষের আভ্যন্তরীণ জটিলতা,
ধর্মীয় ও সামাজিক কুসংস্কারের তীব্র সমালোচনা,
বাস্তব জীবনের করুণ চিত্র,
এবং এক গভীর মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ।
তার লেখনী প্রমাণ করে, সমাজ ও মানুষের চিন্তা-চেতনা এক অদৃশ্য সূতোয় বাঁধা, যেখানে ক্ষমতা, ধর্ম, এবং বেঁচে থাকার তাগিদে মানুষ কখনো কখনো অনৈতিকতাকেও গ্রহণ করে।
Syed Waliullah (তাঁর জন্ম চট্টগ্রাম শহরের ষোলশহর এলাকায়, ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ আগস্ট) তাঁর পিতা সৈয়দ আহমাদুল্লাহ ছিলেন একজন সরকারি কর্মকর্তা; মা নাসিম আরা খাতুনও সমতুল্য উচ্চশিক্ষিত ও রুচিশীল পরিবার থেকে এসেছিলেন, সম্ভবত অধিক বনেদি বংশের নারী ছিলেন তিনি। ওয়ালীউল্লাহর আট বছর বয়সের সময় তার মাতৃবিয়োগ ঘটে। দুই বছর পর তার বাবা দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন টাঙ্গাইলের করটিয়ায়। বিমাতা এবং বৈমাত্রেয় দুই ভাই ও তিন বোনের সঙ্গে ওয়ালীউল্লাহর সম্পর্ক কখনোই অবনতি হয় নি। তার তেইশ বছর বয়সকালে কোলকাতায় চিকিৎসা করতে গিয়ে মারা যান। তার পিতৃমাতৃবংশ অনেক শিক্ষিত ছিলেন। বাবা এম এ পাশ করে সরাসরি ডেপুটি মেজিস্ট্রেট চাকুরিতে ঢুকে যান; মাতামহ ছিলেন কোলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স থেকে পাশ করা আইনের স্নাতক; বড়ো মামা এমএবিএল পাশ করে কর্মজীবনে কৃতি হয়ে খানবাহাদুর উপাধি পেয়েছিলেন এবং স্ত্রী ওয়ালীউল্লাহর বড়ো মামী ছিলেন নওয়াব আবদুল লতিফ পরিবারের মেয়ে, উর্দু ভাষার লেখিকা ও রবীন্দ্রনাথের গল্প নাটকের উর্দু অনুবাদক। ১৯৩৯ সালে তিনি কুড়িগ্রাম উচ্চ বিদ্যালয় হতে ম্যাট্রিক, এবং ১৯৪১ সালে ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। তার আনুষ্ঠানিক ডিগ্রি ছিলো ডিস্টিঙ্কশনসহ বিএ এবং অর্থনীতি নিয়ে এমএ ক্লাশে ভর্তি হয়েও শেষে পরিত্যাগ করেন। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর ওয়ালীউল্লাহ ঢাকায় এসে প্রথমে ঢাকা বেতার কেন্দ্রের সহকারী বার্তা-সম্পাদক ও পরে করাচি কেন্দ্রের বার্তা-সম্পাদক (১৯৫০-৫১) হন। ১৯৫১-৬০ সাল পর্যন্ত তিনি পাকিস্তান সরকারের পক্ষে নয়াদিল্লি, সিডনি, জাকার্তা ও লন্ডনে বিভিন্ন উচ্চ পদে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬০-১৯৬৭ সাল পর্যন্ত তিনি প্যারিসে পাকিস্তান দূতাবাসের ফার্স্ট সেক্রেটারি এবং ১৯৬৭-৭১ সাল পর্যন্ত ইউনেস্কোর প্রোগ্রাম স্পেশালিস্ট ছিলেন। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ দুটি গল্পগ্রন্থ নয়নচারা (১৯৫১), দুই তীর ও অন্যান্য গল্প এবং তিনটি নাটক বহিপীর (১৯৬০), তরঙ্গভঙ্গ (১৯৬৪) ও সুড়ঙ্গ (১৯৬৪) রচনা করেছেন। ছোটগল্প ও নাটকেও তিনি সমাজের কুসংস্কার, ধর্মীয় ভন্ডামি, মানসিক ও চারিত্রিক স্খলন ইত্যাদিকে প্রতিভাসিত করেছেন। তিনি দেশ-বিদেশের নানা সাহিত্য পুরস্কার এবং বাংলাদেশ সরকারের ‘একুশে পদক’ (মরণোত্তর, ১৯৮৩) লাভ করেন। ১৯৭১ সালের ১০ অক্টোবর প্যারিসে তাঁর মৃত্যু হয় এবং প্যারিসের উপকণ্ঠে মদোঁ-স্যুর বেল্ভু-তে তিনি সমাহিত হন।