বাবার কলিংবেলের শব্দ পেয়েই ছোট্ট ছেলেটিকে নিজের রুমে বিছানায় কম্বল মুড়ি দিয়ে শুইয়ে দেয় এলিজাবেথ। ফিস ফিস করে তাকে বোঝায় সে যে কোন শব্দ না করে। কেউ যেনো টের না পায় সে এখানে আছে। তাহলে এলিজাবেথকে ছেড়ে তার চলে যেতে হবে। কি আশ্চর্য ছেলেটি এলিজাবেথের কথা মেনে নেয়। এলিজাবেথ যা বলে হুবহু তাই করে। তার ছোট্ট হৃদয় ইতিমধ্যেই বুঝে গেছে জন্মের পর এতোটা ভালোবাসা সে কোথায়ও কখনো পায়নি। কারো কাছেই পায় না। এলিজাবেথের কথা মতো ঘণ্টাখানেক গুড়ি মেরে বিছানায় পড়ে থাকে বালক। একটুও শব্দ করে না। একটুও নড়ে না। ওদিকে এলিজাবেথ বাবার সঙ্গে রাত্রিকালীন খাদ্য গ্রহণ করে এবং টুকটাক কথা বলে। তারপর বাবা শুয়ে পড়লে সে এসে নিজের রুমের দরোজা বন্ধ করে। দরোজা বন্ধের শব্দ পেয়েই ছেলেটি বিছানায় উঠে বসে। ছেলেটির জন্যে রাতের খাবার আগেই নিজের রুমে এনে লুকিয়ে রেখেছিলো এলিজাবেথ। সেটা বের করে নিজ হাতে, মায়ের মতো অতিশয় আদরে, ভালোবাসায় তাকে খাইয়ে দেয়। এই সময় এলিজাবেথের মুখে যে পরিতৃপ্তির ভাব ফুটে ওঠে তার কোন তুলনা পৃথিবীতে নেই। স্বর্গে থাকলেও থাকতে পারে। এলিজাবেথ এখন আগামীকাল সন্ধে অব্দি নিশ্চিত। সকালবেলা বাবা উঠে কাজে চলে যাবেন। ফিরবেন সন্ধেবেলা। এই দীর্ঘ সময়টা এখন কেবল তার আর ওই ছেলেটির। নিশ্চিন্তে তারা তারপর কম্বলের নিচে ঢুকে যায়। গভীর মায়ামমতায়, স্নেহশীল জননী যেমন তার শিশুকে বুকে জড়িয়ে ধরে তেমন করে ছেলেটিকে বুকে চেপে ধরে এলিজাবেথ। ছেলেটিও, শিশু যেমন তার মাকে ঘুমোবার আগে গলা জড়িয়ে ধরে, তেমন করে জড়িয়ে ধরে। ঘুমিয়ে যায়।
১৯৫৫ সালের ৮ সেপ্টেম্বর বিক্রমপুরের মেদিনীমণ্ডল গ্রামে প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলনের জন্ম। লেখনীশক্তির পাশাপাশি তার রয়েছে নাট্যরচনায় পারদর্শিতা। বর্তমানে বাংলাদেশের মূলধারার সংবাদপত্র ‘কালের কন্ঠ’-এর সম্পাদক পদেও নিয়োজিত রয়েছেন তিনি। শিশুতোষ গল্প দিয়ে সাহিত্য অঙ্গনে এ গুণী লেখকের প্রবেশ, যা প্রকাশিত হয়েছিলো ‘কিশোর বাংলা’ নামক এক পত্রিকায়। তবে পাঠকের নজরে পড়েছিলেন ‘সজনী’ নামের ছোট গল্প লিখে। খুব অল্প বয়সে তিনি লেখালেখিকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। ফলে তার লেখার বিষয়বস্তুতে কোনো জটিল সমীকরণের দেখা মিলতো না, পাঠককে বিমল আনন্দ দেয়ার উদ্দেশ্যে প্রথমদিকে তিনি ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ বিষয়গুলোকে পরিহার করেছিলেন। তবে পরবর্তীতে ইমদাদুল হক মিলন এর বই সমূহ-তে মুক্তিযুদ্ধ, হাজাম সম্প্রদায়ের জীবন, প্রবাসী শ্রমিকদের দুঃখগাথা, পাটচাষী, গ্রাম বাংলার সমাজের এক নিখুঁত চিত্রও ফুটে উঠতে দেখা যায়। এ প্রসঙ্গে লেখকের বক্তব্য, তিনি নিজেই লেখার এরকম বিপরীতধর্মী দুটি ধরন আপন করে নিয়েছেন, আর এক্ষেত্রে তার অণুপ্রেরণা ছিলেন সমরেশ বসু। ইমদাদুল হক মিলন এর বই সমগ্র-তে স্থান পেয়েছে প্রায় দেড় শতাধিক নাটক এবং প্রায় দু’শো উপন্যাস। শিশুতোষ গল্প এবং ভৌতিক উপন্যাস রচনাতেও তার জুড়ি নেই। এই বৈচিত্র্যপূর্ণ সৃষ্টিশীলতার কারণে বাংলা উপন্যাস ইমদাদুল হক মিলন এর কাছে কৃতজ্ঞ। শুধু বাংলাদেশ না, পশ্চিমবঙ্গেও তার সমান জনপ্রিয়তা রয়েছে। দুই বাংলায় আলোড়ন সৃষ্টিকারী তার বহুল পঠিত উপন্যাস হলো ‘নূরজাহান’। এছাড়াও ইমদাদুল হক মিলন এর উপন্যাস সমগ্র বিভিন্ন পাঠকপ্রিয় উপন্যাসে ঠাসা। তাঁর কিছু উল্লেখযোগ্য উপন্যাস হলো ‘জিন্দাবাহার’, ‘নিঝুম নিশিরাতে’, ‘যাবজ্জীবন’, ‘কালাকাল’, ‘কালো ঘোড়া’, ‘ভূমিপুত্র’, ‘পরাধীনতা’, ‘কে’, ‘তাহারা’, ‘ভূতের নাম রমাকান্ত কামার’ ইত্যাদি। দেশি-বিদেশি নানা সম্মানজনক পুরস্কারের পাশাপাশি ২০১৯ সালে তিনি একুশে পদক পান।