জীবনের বিশেষ পর্বে কোনাে বিশেষ প্রকৃতির কাব্য কোন্ উত্তেজনায় স্বাতন্ত্র নিয়ে দেখা দেয়, এ প্রশ্ন কবিকে জিজ্ঞাসা করলে তাকে বিপন্ন করা হয়। কী করে সে জানবে? প্রাণের প্রবৃদ্ধিতে যে-সব পরিবর্তন ঘটতে থাকে তার ভিতরকার রহস্য সহজে ধরা পড়ে না। গাছের সব ডাল একই দিকে একই রকম করে ছড়ায় না; এ দিকে, ও দিকে, তারা বেঁকেচুরে পাশ ফেরে; তার বৈজ্ঞানিক কারণ লুকিয়ে আছে। আকাশে বাতাসে, আলােকে মাটিতে। গাছ যদি-বা চিন্তা করতে পারত তবু সষ্টি প্রক্রিয়ার এই মন্ত্রণাসভায় সে জায়গা পেত না, তার ভােট থাকত না; সে কেবল স্বীকার করে নেয়-এই তার স্বভাবসংগত কাজ। বাইরে বসে আছে যে প্রাণবিজ্ঞানী সে বরঞ্চ অনেক খবর দিতে পারে। কিন্তু বাইরের লােক যদি তাদের পাওনার মূল্য নিয়েই সন্তুষ্ট না থাকে, যদি জিজ্ঞাসা করে মালগুলাে কেমন করে কোন্ ছাঁচে তৈরি হল, হা হলে কবির মধ্যে যে আত্মসন্ধানের হেড়-আপিস আছে সেখানে একবার তাগাদা করে দেখতে হয়। বস্তুত ‘সােনার তরী’ তার নানা পণ্য নিয়ে কোন রপ্তানির ঘাট থেকে আমদানির ঘাটে এস পৌছল, ইতিপূর্বে কখনাে এ প্রশ্ন নিজেকে করি নি; কেননা, এর উত্তর দেওয়া আমার কর্তব্যের অঙ্গ নয়। মূলধন যার হাতে সেই মহাজনকে জিজ্ঞাসা করলে সে কথা কয় না; আমি তাে মাঝি, হাতের কাছেই যা জোটে তাই কুড়িয়ে নিয়ে এসে পৌছিয়ে দিই। 'মানসী'র অধিকাংশ কবিতা লিখেছিলুম পশ্চিমের এক শহরের বাংলা-ঘরে। নতুনের স্পর্শ আমার মনের মধ্যে জাগিয়েছিল নতুন স্বাদের উত্তেজনা। সেখানে অপরিচিতের নির্জন অবকাশে নতুন নতুন ছন্দের যে বুনুনির কাজ করেছিলুম, এর পূর্বে তা আর কখনাে করি নি। নূতনত্বের মধ্যে অসীমত্ব আছে, তারই এসেছিল ডাক; মন দিয়েছিল সাড়া । যা তার মধ্যে পূর্ব হতেই কুঁড়ির মতাে শাখায় শাখায় লুকিয়ে ছিল, আলােতে তাই ফুটে উঠতে লাগল। কিন্তু ‘সােনার তরী’র লেখা আর-এক পরিপ্রেক্ষিতে। বাংলাদেশের নদীতে গ্রামে গ্রামে তখন ঘুরে বেড়াচ্ছি, এর নূতনত্ব চলন্ত বৈচিত্রের নূতনত্ব। শুধু তাই নয়, পরিচয়ে অপরিচয়ে মেলামেশা করেছিল মনের মধ্যে। বাংলাদেশকে তাে বলতে পারি নে বেগানা দেশ; তার ভাষা চিনি, তার সুর চিনি। ক্ষণে ক্ষণে যতটুকু গােচরে এসেছিল তার চেয়ে অনেকখানি প্রবেশ করেছিল মনের অন্দরমহলে আপন বিচিত্র রূপ নিয়ে। সেই নিরন্তর। জানা-শােনার অভ্যর্থনা পাচ্ছিলুম অন্তঃকরণে; যে উদ্বোধন এনেছিল তা স্পষ্ট বােঝা।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম ১৮৬১ সালের ৭ মে (২৫ বৈশাখ ১২৬৮) কলকাতার জোড়াসাঁকোয়। বাবা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ। বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ ভারতীয় মনীষী এবং বিশ্ববিখ্যাত কবি। ছাপার অক্ষরে স্বনামে তাঁর প্রথম প্রকাশিত কবিতা ‘হিন্দু মেলার উপহার’ (৩০.১০.১২৮১ ব.)।
১৮ বছর বয়সের মধ্যে তিনি ‘বনফুল’, ‘কবিকাহিনী’, ‘ভানুসিংহের পদাবলী’, ‘শৈশব সংগীত’ ও ‘রুদ্রচণ্ডু’ রচনা করেন। ‘জ্ঞানাঙ্কুর’ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘ভুবনমোহিনী প্রতিভা’ তাঁর প্রথম গদ্য প্রবন্ধ। ‘ভারতী’র প্রথম সংখ্যায় তাঁর প্রথম ছোটগল্প ‘ভিখারিণী’ এবং প্রথম উপন্যাস ‘করুণা’ প্রকাশিত হয়। ২২ বছর বয়সে নিজেদের জমিদারি সেরেস্তার এক কর্মচারীর একাদশবর্ষীয়া কন্যা ভবতারিণীর (পরিবর্তিত নাম মৃণালিনী) সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয় (৯.১২.১৮৮৩)। পুত্র রথীন্দ্রনাথের শিক্ষা-সমস্যা থেকেই কবির বোলপুর ব্রহ্মচর্য আশ্রমের সৃষ্টি হয় (২২.১২.১৯০১)। সেই প্রতিষ্ঠানই আজ ‘বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়’-এ রূপান্তরিত হয়েছে।
১৯১২ সালের নভেম্বর মাসে গীতাঞ্জলির ইংরেজি অনুবাদ বা ‘ঝড়হম ঙভভবৎরহমং’ প্রকাশিত হয়। ১৯১৩ সালের অক্টোবরে প্রথম ভারতবাসী রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডক্টরেট (১৯১৪) এবং সরকার স্যার (১৯১৫) উপাধিতে ভূষিত করে।
রবীন্দ্রনাথের একক চেষ্টায় বাংলাভাষা সকল দিকে যৌবনপ্রাপ্ত হয়ে বিশ্বের দরবারে সগৌরবে নিজের আসন প্রতিষ্ঠা করেছে। কাব্য, ছোটগল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ, গান প্রত্যেক বিভাগেই তাঁর অবদান অজস্র এবং অপূর্ব। তিনি একাধারে কবি, দার্শনিক, শিক্ষাবিদ, সুরকার, নাট্যপ্রযোজক এবং স্বদেশপ্রেমিক। তাঁর রচিত দুই হাজারের ওপর গানের স্বরলিপি আজো প্রকাশিত হচ্ছে। দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের (ভারত ও বাংলাদেশ) জাতীয় সংগীত-রচয়িতারূপে একমাত্র রবীন্দ্রনাথেরই নাম পাওয়া যায়।