আট এক মাস গ্রামে না ফিরিবার প্রতিজ্ঞা দুদিনের বেশি টিকিল না শশীর। এ-গাঁয়ে ও-গাঁয়ে তার অসহায় বিপন্ন রোগীরা যে পথ চাহিয়া আছে। বিন্দুর সঙ্গে দেখা করিবার ইচ্ছা শশীর আর ছিল না। রওনা হওয়ার দিন বিকালে হঠাৎ অনিচ্ছা জয় করিয়া সে হাজির হইল নন্দর বাড়িতে। নন্দ বাড়ি ছিল। বিন্দু? না, বিন্দুকে এখনও এ বাড়িতে আনা হয় নাই। নন্দ বলিল, ও বাড়ি যাব বলে তৈরি হচ্ছিলাম। দেখা সঙ্গে। তো চলো আমার শশী বলিল, ও বাড়ি যাবার সময় হবে না নন্দ। আজ বাড়ি যাচ্ছি, সাতটায় গাড়ি । আজকেই যাবে? বোসো, চা-টা খাও। শশীর মনে কি এ আশা ছিল যে গাওদিয়ার বাড়িতে টিকিতে না পারিলেও নন্দর গৃহে গৃহিণী হইয়া বিন্দু থাকিতে পারিবে? বিন্দু আসে নাই শুনিয়া সে যেন বড়ো দমিয়া গেল। নন্দর বাড়িঘর দেখিয়া সে একটু অবাক হইয়া গিয়াছিল। এখানে আগে সে কখনও আসে নাই, —নন্দর গৃহে বনেদিত্বের ছাপ যে এত স্পষ্ট ও প্রীতিকর এ ধারণা তাহার ছিল না। সেকেলে ধরনের ভারী নিরেট সব আসবাব, দরজা জানালায় দামি পুরু পর্দা, দেয়ালে প্রকাণ্ড কয়েকটা অয়েলপেন্টিং, এমনি সব গৃহসজ্জা নন্দর এই ঘরখানাকে একটি অপূর্ব গম্ভীর শ্রী দিয়াছে। অন্দর বোধ হয় বেশি তফাতে নয়,—কোমল গলার কথা ও হাসি শশীর কানে আসিতেছিল, —সে অনুভব করিতেছিল অন্তরালের একটি বৃহৎ সুখী পরিবারের অস্তিত্ব । তারপর একসময় সাত-আট বছর বয়সের একটি সুশ্রী ছেলে কী বলিতে আসিয়া শশীকে দেখিয়া নন্দর গা ঘেঁষিয়া দাঁড়াইয়া পড়িল। কী সুন্দর তার দুটি কৌতূহলী চোখ ! আর কী মায়া নন্দর চোখে !
শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রাম, মধ্যবিত্ত সমাজের কৃত্রিমতা, নিয়তিবাদ ইত্যাদি বিষয়কে লেখার মধ্যে তুলে এনে বাংলা সাহিত্যে যিনি অমর হয়েছেন, তিনি হলেন প্রখ্যাত ভারতীয় বাঙালি কথাসাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। খ্যাতিমান এই সাহিত্যিক ১৯০৮ সালের ১৯ মে বিহারের সাঁওতাল পরগনায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর প্রকৃত নাম প্রবোধকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, আর মানিক ছিলো তাঁর ডাকনাম। বাবার বদলির চাকরিসূত্রে তাঁর শৈশব, কৈশোর ও ছাত্রজীবন কেটেছে বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে, যার ফলে বিভিন্ন অঞ্চলের পটভূমিতে বিভিন্ন সাহিত্য রচনা করেছেন তিনি। প্রবেশিকা ও আইএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার পর মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় গণিত বিষয়ে অনার্স করতে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। এখানে পড়াশোনাকালে বন্ধুদের সাথে বাজি ধরে তিনি 'অতসী মামী' গল্পটি লেখেন। সেই গল্পটি বিখ্যাত 'বিচিত্রা' পত্রিকায় ছাপানো হলে তা পাঠকনন্দিত হয় এবং তিনি সাহিত্যাঙ্গনে পরিচিত হয়ে ওঠেন। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি সাহিত্য রচনায় পুরোপুরি মনোনিবেশ করেন, যার ফলে তাঁর পড়াশোনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এবং তিনি আর পড়াশোনা শেষ করতে পারেননি। তাঁর হাতে বাংলা সাহিত্যে এক বৈপ্লবিক ধারা সূচিত হয় ঐ সময়ে, যখন সারা পৃথিবী জুড়ে মানবিক বিপর্যয়ের এক চরম সংকটময় মুহূর্ত চলছে। কমিউনিজমের দিকে ঝুঁকে যাওয়ায় তাঁর লেখায় একসময় এর ছাপ পড়ে এবং মার্ক্সীয় শ্রেণীসংগ্রাম তত্ত্ব দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমগ্র। ফ্রয়েডীয় মনোসমীক্ষণেরও প্রভাব লক্ষ্য করা যায় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র-তে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমূহ এর মধ্যে 'পদ্মানদীর মাঝি', 'দিবারাত্রির কাব্য', 'পুতুলনাচের ইতিকথা', 'শহরতলি', 'চতুষ্কোণ', 'শহরবাসের ইতিকথা' ইত্যাদি বিখ্যাত উপন্যাস, এবং 'আত্মহত্যার অধিকার', 'হারানের নাতজামাই', 'বৌ', 'প্রাগৈতিহাসিক', 'সমুদ্রের স্বাদ', 'আজ কাল পরশুর গল্প' ইত্যাদি গল্পগ্রন্থ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতা রচনার কিছু নিদর্শন থাকলেও সেগুলো তেমন উল্লেখযোগ্যতা অর্জন করেনি। অসামান্য এই কথাসাহিত্যিক মাত্র ৪৮ বছর বয়সে ১৯৫৬ সালের ৩ ডিসেম্বর মৃত্যুবরণ করেন।