"গল্পসমগ্র" — সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্-এর লেখা এই সংকলনটি বাংলা সাহিত্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। এই গ্রন্থে তাঁর লেখা বিভিন্ন ছোটগল্প একত্রে সংকলিত হয়েছে, যা মূলত মানুষের অন্তর্দ্বন্দ্ব, গ্রামীণ সমাজব্যবস্থা, ধর্মীয় কুসংস্কার, এবং আত্মিক সংকটকে তুলে ধরে। নিচে বইটির একটি সারাংশ তুলে ধরা হলো:
বইয়ের সারমর্ম:
"গল্পসমগ্র" বইটিতে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ তাঁর গভীর জীবনদর্শন এবং বাস্তবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে বাংলা ছোটগল্পকে এক নতুন মাত্রায় পৌঁছে দেন। তাঁর গল্পগুলোতে সাধারণত দেখা যায়:
গ্রামীণ জীবনের বাস্তব চিত্রণ: গ্রামের সাধারণ মানুষ, তাদের জীবনযাপন, দুঃখ-বেদনা, আশা-নিরাশার ছবি ফুটে উঠেছে গল্পে।
মানসিক ও আধ্যাত্মিক দ্বন্দ্ব: চরিত্ররা প্রায়ই ধর্মীয়, সামাজিক ও ব্যক্তিগত সংকটে পড়ে, যার ফলে তাদের ভেতরের দ্বন্দ্ব স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
কুসংস্কার ও ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ: অনেক গল্পে ওয়ালীউল্লাহ্ দেখিয়েছেন কীভাবে ধর্মের নামে মানুষকে শোষণ করা হয় এবং কীভাবে কেউ কেউ সেই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে দাঁড়ায়।
চরিত্রচিত্রণ ও মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ: তাঁর গল্পে চরিত্রগুলো জীবন্ত এবং জটিল—তাদের চিন্তা-ভাবনা, আবেগ এবং অভ্যন্তরীণ টানাপোড়েন অত্যন্ত গভীরভাবে উপস্থাপিত।
গুরুত্বপূর্ণ কিছু গল্পের থিম:
১. "দুই পুরুষ" – প্রজন্মগত দ্বন্দ্ব এবং বিশ্বাসের সংঘাত। ২. "মুখোশ" – সমাজে নিজেকে টিকিয়ে রাখতে মানুষের ভান ও আত্মপ্রবঞ্চনার চিত্র। ৩. "কান্না" – দুঃখের বহিঃপ্রকাশ এবং মানুষের নির্জন কষ্টের ভাষা।
উপসংহার:
"গল্পসমগ্র" বইটি সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র সাহিত্যকর্মের একটি দর্পণ। তাঁর গল্পগুলো পাঠকের মনে একধরনের চাপা বিষণ্নতা ও গভীর ভাবনার জন্ম দেয়। এটি শুধুই গল্পের সংকলন নয়—এটি বাংলাদেশের সাহিত্য, সমাজ এবং মানুষের মনোজগতের একটি সংবেদনশীল প্রতিচ্ছবি।
Syed Waliullah (তাঁর জন্ম চট্টগ্রাম শহরের ষোলশহর এলাকায়, ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ আগস্ট) তাঁর পিতা সৈয়দ আহমাদুল্লাহ ছিলেন একজন সরকারি কর্মকর্তা; মা নাসিম আরা খাতুনও সমতুল্য উচ্চশিক্ষিত ও রুচিশীল পরিবার থেকে এসেছিলেন, সম্ভবত অধিক বনেদি বংশের নারী ছিলেন তিনি। ওয়ালীউল্লাহর আট বছর বয়সের সময় তার মাতৃবিয়োগ ঘটে। দুই বছর পর তার বাবা দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন টাঙ্গাইলের করটিয়ায়। বিমাতা এবং বৈমাত্রেয় দুই ভাই ও তিন বোনের সঙ্গে ওয়ালীউল্লাহর সম্পর্ক কখনোই অবনতি হয় নি। তার তেইশ বছর বয়সকালে কোলকাতায় চিকিৎসা করতে গিয়ে মারা যান। তার পিতৃমাতৃবংশ অনেক শিক্ষিত ছিলেন। বাবা এম এ পাশ করে সরাসরি ডেপুটি মেজিস্ট্রেট চাকুরিতে ঢুকে যান; মাতামহ ছিলেন কোলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স থেকে পাশ করা আইনের স্নাতক; বড়ো মামা এমএবিএল পাশ করে কর্মজীবনে কৃতি হয়ে খানবাহাদুর উপাধি পেয়েছিলেন এবং স্ত্রী ওয়ালীউল্লাহর বড়ো মামী ছিলেন নওয়াব আবদুল লতিফ পরিবারের মেয়ে, উর্দু ভাষার লেখিকা ও রবীন্দ্রনাথের গল্প নাটকের উর্দু অনুবাদক। ১৯৩৯ সালে তিনি কুড়িগ্রাম উচ্চ বিদ্যালয় হতে ম্যাট্রিক, এবং ১৯৪১ সালে ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। তার আনুষ্ঠানিক ডিগ্রি ছিলো ডিস্টিঙ্কশনসহ বিএ এবং অর্থনীতি নিয়ে এমএ ক্লাশে ভর্তি হয়েও শেষে পরিত্যাগ করেন। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর ওয়ালীউল্লাহ ঢাকায় এসে প্রথমে ঢাকা বেতার কেন্দ্রের সহকারী বার্তা-সম্পাদক ও পরে করাচি কেন্দ্রের বার্তা-সম্পাদক (১৯৫০-৫১) হন। ১৯৫১-৬০ সাল পর্যন্ত তিনি পাকিস্তান সরকারের পক্ষে নয়াদিল্লি, সিডনি, জাকার্তা ও লন্ডনে বিভিন্ন উচ্চ পদে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬০-১৯৬৭ সাল পর্যন্ত তিনি প্যারিসে পাকিস্তান দূতাবাসের ফার্স্ট সেক্রেটারি এবং ১৯৬৭-৭১ সাল পর্যন্ত ইউনেস্কোর প্রোগ্রাম স্পেশালিস্ট ছিলেন। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ দুটি গল্পগ্রন্থ নয়নচারা (১৯৫১), দুই তীর ও অন্যান্য গল্প এবং তিনটি নাটক বহিপীর (১৯৬০), তরঙ্গভঙ্গ (১৯৬৪) ও সুড়ঙ্গ (১৯৬৪) রচনা করেছেন। ছোটগল্প ও নাটকেও তিনি সমাজের কুসংস্কার, ধর্মীয় ভন্ডামি, মানসিক ও চারিত্রিক স্খলন ইত্যাদিকে প্রতিভাসিত করেছেন। তিনি দেশ-বিদেশের নানা সাহিত্য পুরস্কার এবং বাংলাদেশ সরকারের ‘একুশে পদক’ (মরণোত্তর, ১৯৮৩) লাভ করেন। ১৯৭১ সালের ১০ অক্টোবর প্যারিসে তাঁর মৃত্যু হয় এবং প্যারিসের উপকণ্ঠে মদোঁ-স্যুর বেল্ভু-তে তিনি সমাহিত হন।