মীরা, একটি চাকরি করবে? কী চাকরি? আমার তো কোনো যোগ্যতাই নেই। কে দেবে আমায় চাকরি? করবে কি না, তা বলো? তুমি বললে অবশ্যই করব। চাকরির ধরণ হলো, কাপড় আয়রন করে দিতে হবে, জুতা এগিয়ে দিতে হবে। অফিসে যাওয়ার আগে খাবারের বক্স রেডি করে দিতে হবে। টাই বেঁধে দিতে হবে, গল্প করতে হবে, ঝগড়া করতে হবে। একটা নিষ্পাপ মেয়ের যত্ন নিতে হবে? করবে চাকরি? মাহিয়ান! জি। করবে আমার চাকরি? এবং এ চাকরি ছেড়ে কোনো দিন যেতে পারবে না। এ চাকরি করতে হবে আমৃত্যু পর্যন্ত। মীরার গাল বেয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। কী বলবে কিছু ভেবে পাচ্ছে না। শুধু ফ্যালফ্যাল করে মাহিয়ানের দিকে তাকিয়ে রইল। এ অশ্রু আনন্দাশ্রু। মীরা বলল, না, আমি আর কোথাও যাব না! কোথাও না! মাত্র ৬৪ পৃষ্ঠার একটি উপন্যাস। খুব পরিপাটি, ঘটনার পট পরিবর্তনে নাটকীয়তা, চরিত্রগুলোর মধ্যে মানসিক টানাপড়েন আর ভালোবাসার খরস্রোত এ উপন্যাসকে করে তুলেছে অনন্য। মীরার হাউজ টিউটর মাহিয়ান। গ্রামের স্বচ্ছল একটি পরিবারের ছেলে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী স্টুডেন্ট। হলে থেকে ভালো কাটছিল জীবন। কিন্তু রাজনৈতিক গোলযোগে হল ছেড়ে বাইরে বাসা ভাড়া নিতে হলো। কিন্তু বাসা এতোই দূরে সে সেখান থেকে এসে মীরাকে পড়ানো সম্ভব না। মীরার বাবার অনুরোধে মীরাদের বাসাতেই উঠতে হলো মাহিয়ানকে। দিনে দিনে মাহিয়ানের প্রতি মীরার ভালোবাসা জন্মে। কিন্তু এ ভালোবাসার কোনো পরিণতি পায় না। মীরার মা চায় না মাহিয়ানের সাথে সম্পর্ক হোক তাদের পরিবারের। মঞ্জুর এ এলাহীর এ উপন্যাসটি পাঠে উঠে আসে আমাদের সমাজ বাস্তবতার চিত্র। মানুষের সম্পর্কের নানামুখি বৈচিত্র্যতাকে গভীরভাবে বুঝতে এ উপন্যাস পাঠ করতে হবে। মীরার অন্যত্র বিয়ে। মীরার স্বামীর প্রতারণা। মাহিয়ানের বিয়ে করা। স্ত্রীর মৃত্যু! সবই ঘটতে থাকে সময়ের সাথে সাথে। সময়কে অতিক্রম করে কেউ যেনো এগিয়ে যেতে পারে না। দুঃখ, হতাশা, পাওয়া না পাওয়ার এক সম্মিলিত আয়োজন এ বইটি। চরিত্রের প্রয়োজনে অনেক রোমান্টিক দৃশ্যের দেখা মেলে এ উপন্যাসটিতে। কেবল অপরিহার্য চরিত্রগুলোই এ উপন্যাসকে প্রাণময় করে তুলছে। ভাষা, বর্ণনা কিংবা দার্শনিকবোধ সৃষ্টিতে উপন্যাসিককে আরো মনোযোগী হতে হবে। তবে তার একটা চেষ্টা যে তিনি করেছেন তা বলাই যায়। অনেক ঝড় শেষে প্রকৃতি যেমন নিরব নিশ্চুপ হয়ে যায় তেমনি মীরা আর মাহিয়ানের জীবনের ঝড় থেকে পরস্পর পরস্পরকে কাছে পায়। তাই কেউ কাউকে ছেড়ে আর কোথাও না যাবার প্রত্যয়ী হয়ে ওঠে অবশেষে। বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর মঞ্জুর এ এলাহির জন্ম মানিকগঞ্জ জেলার হরিরামপুর উপজেলার পদ্মাতীরে দানিস্তপুর গ্রামে। লেখালেখি নিয়েই তার চিন্তা ভাবনা। তার পাঠক দিন দিন বৃদ্ধি পাক ও একই সাথে কালজয়ী লেখার স্রষ্টা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করুক এই প্রত্যশা পাঠকমাত্রই।
মঞ্জুর এ এলাহী—সমকালীন কথাসাহিত্যে এক স্বতন্ত্র, পরিশীলিত কণ্ঠস্বর। শব্দের নিপুণ নির্মাণে জীবনকে গল্পের আয়নায় তুলে ধরার যে শিল্প, তিনি তারই এক দক্ষ সাধক। জন্ম ১৯৯২ সালের ৭ই ডিসেম্বর, মানিকগঞ্জ জেলার হরিরামপুর উপজেলার পদ্মা-তীরবর্তী দানিস্তপুর গ্রামে। পিতা বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও সাংবাদিক সিকান্দার আবু জাফর, মাতা ফাহিমা বেগম। পরিবার থেকেই পেয়েছেন সাহিত্যচর্চার প্রেরণা ও দায়বদ্ধতার বীজমন্ত্র। তিনি বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী এবং কথাসাহিত্য নিয়ে করেছেন একাধিক প্রশিক্ষণ ও কোর্স। পাণ্ডুলিপির চেয়ে জীবনের গল্প তার কাছে বড়, আর সেই জীবনকেই তিনি রূপ দেন কথাসাহিত্যের রূপকে। সাহিত্যচর্চাকে তিনি দেখেন এক চিরকালীন দায়বোধ হিসেবে—যেখানে অনুভব, প্রতিরোধ, প্রেম ও প্রবণতা একইসাথে ছায়া ফেলে চরিত্রের অবয়বে। তার প্রথম উপন্যাস ‘রক্তাক্ত চিঠি’ পাঠকসমাজে কুড়িয়েছে প্রশংসা। দ্বিতীয় উপন্যাস ‘আমি আর কোথাও যাব না’ তার লেখকসত্তার পরিপক্ব ও বর্ণময় বিকাশের সাক্ষ্য দেয়। সমসাময়িক বাস্তবতা, ব্যক্তিমানুষের টানাপোড়েন ও অন্তর্জগতের প্রতিধ্বনি তার গদ্যে অনুরণিত হয় গভীর মানবিক বোধে। তিনি দেশের প্রথম সারির বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকের সাহিত্য ম্যাগাজিনে নিয়মিত লেখেন এবং ২০১৭ সালে অর্জন করেন তরুণ লেখক সম্মাননা পুরস্কার—যা তার সাহিত্যিক অভিযাত্রার একটি গুরুত্বপূর্ণ স্বীকৃতি। মঞ্জুর এ এলাহীর স্বপ্ন—এই পৃথিবীকে তিনি গল্পের শহরে রূপ দেবেন। সেই শহরের প্রতিটি অলিগলি ভালোবাসার গল্পে মুখরিত থাকবে। সে স্বপ্নই তার সৃজনশীলতার অভিমুখ এবং সাহিত্যিক অন্বেষণের নিরন্তর প্রেরণা।