আফগানিস্তান নিয়ে আমাদের দেশের মানুষের মধ্যে কৌতূহল দীর্ঘদিনের। বিশেষ করে যারা কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘কাবুলিওয়ালা’ গল্প আর সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘দেশে বিদেশে’ ও ‘শবনাম’ পড়েছেন। এই কৌতূহল আরো বেড়েছে ৮০ ও ৯০ দশকে, যখন আমাদের দেশের পত্র-পত্রিকায় পশ্চিমা সংবাদ মাধ্যমের বিকৃত ও আধাবিকৃত তথ্যের উদ্বৃতি দিয়ে আফগানিস্তান সম্পর্কে দিনের পর দিন সংবাদ পরিবেশন করে। ১৯৯৬ সালে আফগানিস্তানে তালেবানদের ক্ষমতা দখলের পর এই কৌতূহল আরো বৃদ্ধি পায়। কিন্তু কৌতূহল নিবৃত্ত করার জন্য প্রয়োজনীয় কোনো পদক্ষেপ বা উদ্যোগ নেয়া হয়নি। বরং উল্টো ঘটনা ঘটেছে। আমাদের দেশের এক শ্রেণির সাংবাদিক, লেখক ও বুদ্ধিজীবীরা পশ্চিমা সংবাদ মাধ্যমের অর্ধসত্য ও অর্ধবিকৃত তথ্য পশ্চিমা দৃষ্টিকোণ থেকে (উপনিবেশিক মানসিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গী) বিচার বিশ্লেষণ করেছেন। ফলে আফগানিস্তান সম্পর্কে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে। জনমনে এমন একটা ধারণা সৃষ্টি হয়েছে যে, আফগানিস্তান একটা পশ্চাৎপদ, গরিব, ফকির, সম্পদবিহীন, বিদেশি সাহায্য নির্ভর দেশ। ওই দেশের মানুষ অশিক্ষিত বর্বর। কিন্তু সত্যিই কি তাই? না, মোটেও তা নয়। বরং আফগানিস্তান একটা ঐতিহ্যম-িত প্রাচীন সভ্যতার সম্পদশালী দেশ। স্বাধীনতার জন্য নিরন্তর লড়াই সংগ্রামের দেশ।
সম্রাজ্যবাদী যুগে ব্রিটিশ সম্রাজ্যবাদ চার চার বার আফগানিস্তান দখলের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে। আফগানিস্তান দখলের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে জার সাম্রাজ্যও। আর সর্বশেষ বর্তমান বিশ্বের একনম্বর পরাশক্তি মার্কিন সম্রাজ্যবাদের পরিণতি তো বিশ্ববাসীর সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষও প্রত্যক্ষ করলো।
আফগানিস্তান নিয়ে পশ্চিমা দুনিয়ার পাশাপাশি ভারতের সংবাদপত্রেও অর্ধসত্য অর্ধবিকৃত ও উদ্দেশ্যমূলক তথ্য পরিবেশন করে দুনিয়ার মানুষকে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে। এই বিভ্রান্তি দূর করার ও প্রকৃত সত্য জানা-বুঝার জন্য আফগানিস্তানের ইতিহাসের প্রতি দৃষ্টি দেয়ার কোনো বিকল্প নেই। আফগানিস্তানের ইতিহাসের প্রতি দৃষ্টি দিলে, ইতিহাস পাঠ করলে, সহজেই জানা যাবে আফগানিস্তান একটা ঐতিহ্যম-িত দেশ। ওই দেশে ভারত-বাংলাদেশের মতো যেমন ধর্মীয় মৌলবাদের ধারা আছে, তেমনি প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক রাজনীতির ধারাও আছে।
আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের, বিশেষ করে মার্কিন সম্রাজ্যবাদের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক ধারা পরাজিত হলেও সম্রাজ্যবাদের কাছে আত্মসমর্পণ করেনি। দেশের প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক আন্দোলনের লড়াকু ছাত্র-জনতাকে বিপদের মুখে রেখে প্রগতিশীল আন্দোলনের সর্বোচ্চ নেতৃত্ব ও দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাননি। বরং দেশে থেকে বীরের মতো জীবন উৎসর্গ করেছেন আগামীদিনের লড়াই সংগ্রামের সাহস ও প্রেরণা যোগাতে। সেই লড়াই সংগ্রামের ইতিহাস আফগানদের ঐতিহ্যম-িত ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। সেই সাথে তালেবানদের নিয়েও যে বিভ্রান্তি আছে তা দূর করার জন্য তালেবান শাসনের ইতিহাস জানা আবশ্যক। জানা আবশ্যক, তালেবান নেতৃত্বের পরিবর্তিত কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গী ও কূটনৈতিক তৎপরতা। এই সব দিক চিন্তা-ভাবনা ও বিচার বিশ্লেষণ করে আমি একটি বই লেখার চিন্তা করি। আমার সেই চিন্তার ফসল ‘তালেবান শাসন, আফগান ইতিহাসের পুনঃপাঠ’।
আমার বিশ্বাস এই বই আফগানিস্তান সম্পর্কে জনমনের কৌতূহল অনেকখানি নিবৃত্ত করবে। অন্যদিকে, আফগান জাতির বীরচিত লড়াই সংগ্রাম আফগানিস্তান সম্পর্কে চিন্তার নতুন খোরাক যোগাবে। যা আজকের যুগে অত্যন্ত জরুরি ও আবশ্যক।
এই বইটি লিখতে আমাকে যারা সাহায্য সহযোগিতা করেছেন, উৎসাহ দিয়েছেন তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি, দীর্ঘদিনের সহকর্মী-সহযোদ্ধা ইকবাল মোহম্মদ খানকে। যিনি জাতীয় প্রেসক্লাব লাইব্রেরিতে আমাকে বিভিন্নভাবে সময় দিয়েছেন, সহযোগিতা করেছেন। কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি, সম্রাট শাহজাহানের প্রতিও। তিনি বইটির একটি চমৎকার প্রচ্ছদ করেছেন। সবশেষে প্রকাশক এম. সহীদুল ইসলামের প্রতিও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি, কারণ তিনি বিশেষ উদ্যোগ না নিলে দ্রুততম সময়ে বইটির প্রকাশ সম্ভব হতো না।
মাহবুব আলম পেশায় একজন সাংবাদিক। আশির দশকে 'দৈনিক দেশ বাংলা' ও 'সাপ্তাহিক নতুন কথা' দিয়ে সাংবাদিকতা শুরু করেন। এরপর আজকের কাগজে প্রথমে চিফ রিপোর্টার পরে সিটি এডিটর এবং 'বাংলা ভিশন', 'যায়যায়দিন' ও 'ভোরের ডাক'-এ নিউজ এডিটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। বর্তমানে 'এবি নিউজ টোয়েন্টি ফোর বিডি ডট কম' ও 'তাস টেলিভিশন'-এর উপদেষ্টা সম্পাদক। সাংবাদিকতার পাশাপাশি রাজনীতিতেও সক্রিয় ছিলেন দীর্ঘদিন। ১৯৭০ সালে নারিন্দা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্রাবস্থায় 'পাকিস্তান দেশ ও কৃষ্টি' নামের একটি বই বাতিলের দাবিতে স্কুল ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আন্দোলনে অংশ নেন। ছাত্র আন্দোলনে সংশ্লিষ্ট হন। প্রথমে ছাত্র ইউনিয়ন পরে বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের সক্রিয় কর্মী। স্বাধীনতাত্তোর রাজনীতিতে সংগঠক হিসেবে নিরবচ্ছিন্ন থেকেছেন নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের পরও। ১৯৮০-তে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির ঢাকা মহানগর কমিটিতে ও চার বছর পর ১৯৮৪-তে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি এরশাদ সামরিক জান্তা বিরোধী গণআন্দোলনে ঢাকা মহনগরীর অন্যতম সংগঠক ছিলেন। বর্তমানে বাংলাদেশর কমিউনিস্ট পার্টি- সিপিবি'র সদস্য। এছাড়াও জাতীয় প্রেস ক্লাব ও ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির স্থায়ী সদস্য। সাংবাদিকতার পাশাপাশি লেখক হিসেবেও তিনি পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। 'প্রাসাদ হত্যাকাণ্ড ও নেপালের রাজনীতি' এবং 'নেপাল: রাজতন্ত্র থেকে প্রজাতন্ত্র' নামের দুইটি গবেষণা গ্রন্থ তার বহুল আলোচিত। তার প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ১৫। 'তালেবান শাসন: আফগান ইতিহাসের পুনঃপাঠ তার ১৬তম বই।