সংবিধান আমার প্রিয়তম বিষয়।
সংবিধানের পরতে পরতে লুকিয়ে আছে নানা রহস্য। আইনের ভাষা এমনই, একটু রহস্যময়। আর সংবিধান তো সকল আইনের মূল আইন। ফলে, এর ভাষা আরো বর্ণময়, প্রাণবন্ত, উচ্ছ¡ল ও ঝঙ্কারময়। শয়নে, স্বপনে, জাগরণেজ্জ সবসময় এক ধরনের ঘোরে থাকি, যেন প্রতিনিয়ত কানে সংবিধান বেজে চলেছে।
সংবিধান একটি নিত্য গতিশীল ও বিকাশমান সত্তা। প্রতি যুগের, প্রতি কালের পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার এক অসামান্য ঋজু অথচ কোমল (স্ট্রং ইয়েট ফ্লেক্সিবল) উপাদান আছে এর মধ্যে। আমার কাছে মনে হয়, সংবিধান একটি বাদ্যযন্ত্রের মতো; একে বাজাতে হয়, এটি নিজে নিজে বেজে উঠে না। আনাড়ি বাজনদারের হাতে যেমন বাদ্যযন্ত্র বাজে না, তেমনি সচেতন ও সংবিধানের গভীর পঠন-পাঠনে ঋদ্ধ বিচারক, আইনজীবী ও লিগ্যাল অ্যাকাডেমিকস্ ছাড়া সংবিধান তার স্বমহিমায় উদ্ভাসিত হয়ে গৌরবের আসনে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না।
সংবিধান একটি জাতির ও রাষ্ট্রের সবচেয়ে মৌলিক ও কেন্দ্রীয় দলিল। প্রকৃত অর্থ উদ্ধার করার জন্য এর প্রতি বহুমুখী ও সৃজনশীল উপায়ে আলোকপাত, অ্যাপ্রোচ করার প্রয়োজন আছে। কেননা, সংবিধানের নিজস্ব ভাষা আছে, সেজন্য সেই ভাষা আবিষ্কার করার বিষয়ও আছে। এই ভাষা জীবন্ত, ফলে সংবিধানের ভাষা যুগের সাথে তাল মিলিয়ে নতুন নতুন অর্থে বিকশিত হতে পারে বা হওয়ার সক্ষমতা রাখে। দেশের সর্বোচ্চ আদালত বা বিচারপতিবৃন্দের কাজই হলো প্রতি মুহূর্তে নিত্য নতুন, গতিশীল ও অভিনব অথচ ভারসাম্যপূর্ণ ব্যাখ্যার মাধ্যমে সংবিধানকে পরিবর্তনশীল সমাজ ও রাষ্ট্রের উপযোগী করে ব্যাখ্যা করা।
সংবিধানকে বুঝতে হয় এর কতগুলো মাত্রা দিয়ে– বিচিত্র, বিস্তৃত, বহুমুখী ও সুগভীর পঠন-পাঠনের মধ্য দিয়ে। সংবিধানের ভেতরগত বা অন্তর্গত মাত্রাই এর মূল মাত্রা, অর্থাৎ এর চেতনা বা ঝঢ়রৎরঃ। কিন্তু সমানভাবে এর একটি বহিরঙ্গনিগত মাত্রাও রয়েছে, সেটি হলো এর টেক্সট্, এর গঠন, এর বাক্য, এর শব্দসমষ্টি এবং সর্বোপরি এর সার্বিক ক্যানভাস বা বিন্যাস, ইত্যাদি। তাই, সংবিধানের যেমন ঝঢ়রৎরঃ আছে, তেমনি এর গড়ৎঢ়যড়ষড়মু-ও আছে, এবং দুটোই সমান গুরুত্বপূর্ণ। একটিকে ছাড়া অন্যটি অসম্পূর্ণ।
যে কোনো ভাষার তিনটি বৈশিষ্ট্য থাকে। এদের মধ্যে ভাষার রূপতাত্তি¡ক বা মরফোলজিক্যাল উপাদানটি সেই ভাষার অন্তর্গত কাঠামোটি বুঝতে সহায়তা করে। আমাদের সংবিধানের এই বৈশিষ্ট্যটি নিয়ে আজও কোনো কাজ হয়নি। এই বিষয়ে আমি এই বইয়ে নমুনা হিসেবে আংশিক কাজ করার চেষ্টা করেছি।
এই বই পড়লে মনে হবে যেন ভাঁজ খুলে খুলে আপনি সংবিধান পড়ছেন! সংবিধানের যে অদেখা কাঠামোটি আছে সেই কাঠামো উন্মোচনের এক বিনীত প্রচেষ্টা গ্রহণ করা হয়েছে এই বইয়ে। এই বই পড়তে গিয়ে হয়তো বা আপনার মনে হবে, তাই তো, সংবিধানকে এর আগে কেন এভাবে দেখিনি বা ভাবিনি?
এ বছর বাংলাদেশের সংবিধানের বয়স পঞ্চাশ পূর্ণ হতে চলেছে। প্রয়োজন বা গুরুত্ব থাকা সত্তে¡ও গত পাঁচ দশকে সংবিধানের গঠনগত চরিত্রের, এর সবলতার, দুর্বলতার নানান দিকের ওপর পর্যাপ্ত গবেষণা ও অনুসন্ধান হয়নি। বাংলাদেশে সংবিধান-চর্চা এখনও আংশিক ও আধখ্যাঁচড়া, সত্যি বলতে প্রায় অস্তিত্বহীন!
এই বইয়ে সংবিধান বিষয়ে আমার কিছু অনুসন্ধানের ফলাফল তুলে ধরা হয়েছে। আমি যেভাবে সংবিধানকে ও এর বিভিন্ন উপাদানকে এখানে তুলে ধরেছি সেভাবে না দেখলে যে সংবিধান ব্যর্থ হয়ে যাবে তা কিন্তু নয়। তবে, রাষ্ট্রের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ ও মৌলিক এই দলিল বিষয়ে অজ্ঞতাও নিশ্চয়ই আমাদের গৌরব বৃদ্ধি করে না। সংবিধানে যা আছে তা কীভাবে আছে, এবং কেন এভাবে আছে—সেসব জানা থাকা ভালো। আর সেজন্যই আমার এই উদ্যোগ ও প্রচেষ্টা।