মানুষ চিরকালই রহস্যপ্রিয়। আর বর্তমানে গোয়েন্দা উপন্যাসের প্রতি পাঠকের আগ্রহ বিশ্বময়। যা রহস্যময়, অতিপ্রাকৃত; যে জগতের দেখা পাওয়া যায় না, তার প্রতি স্বাভাবিকভাবেই মানুষের আকর্ষণ বেশি। অলৌকিকত্ব বা অতিপ্রাকৃত ঘটনা--- তা যতই যুক্তিবাদীরা অস্বীকার করবার চেষ্টা করুক না কেন--- আমাদের অনেকের সাথেই এমন অনেক ঘটনাই ঘটে যা যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয় না। এগুলোই অতিপ্রাকৃত ও অলৌকিক ঘটনা হিসেবে ব্যাখ্যাতীত রহস্যের বেড়াজালে ঘেরা থাকে, যা পড়তে পড়তে পাঠক শিহরিত হয়, পড়ে শেষ করার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকে; কারণ কীভাবে শেষ হয়, শেষে কী হয় এই ভাবনা-রহস্যের শেষ দেখতে পাঠক হয় নাছোড়বান্দা।
দেবযান ও মিসমিদের কবচ এমনই দুটি উপন্যাস যা পাঠক অতিপ্রাকৃত উপন্যাস গ্রন্থে একমলাটে হাতে পাচ্ছেন।
বাংলা ও বাঙালির কথক-সাধক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় একটি অমর নাম, বহমান সময়ের মধ্যে জ্বলজ্বল করা অপার বিস্ময়। সহজ ভাষা, দেশি শব্দ, চেনা পৃথিবীর আটপৌরে ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ দৃশ্যাবলির সমাবেশে মুখর হয়ে আবেগ ও কষ্ট, ভালোবাসা ও নির্দয়তা, জীবন ও প্রকৃতির অনাবিল বুনটে একমেবাদ্বিতীয়ম হয়ে উঠেছে তাঁর কথাসাহিত্য। তাঁর মতো নিপুণ গদ্যশিল্পী আরও কয়েকজন আছেন, কিন্তু রসসৃষ্টিতে তাঁর সমকক্ষ কেউ নেই বললে অত্যুক্তি হবে না। জীবন-রস পরিবেশনে তিনি অপ্রতিদ্বন্দ্বী, অনন্য। বিভূতিভূষণ সামগ্রিক জীবনের লেখক। অন্যান্য বিষয়ের মতো অধ্যাত্ম, অতিপ্রাকৃত উপন্যাস বা গল্প লিখতেও তিনি সিদ্ধহস্ত। যা পাঠককে নাড়া দেয়, গভীরভাবে ভাবায়, বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোরগোড়ায় এসে হুমড়ি খায়। শেষমেশ কয়েকদিনের আবছায়া ভয়ে শিহরিত হয়ে পাশ কাটিয়ে চলে যায়। বিভূতিভূষণের পুত্র তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের উক্তি এক্ষেত্রে প্রণিধানযোগ্য---
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পথিকৃৎ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় বেশ কিছু কালজয়ী উপন্যাস রচনার মাধ্যমে জয় করে নিয়েছেন বাংলা ভাষাভাষী পাঠকদের হৃদয়। শুধু উপন্যাসই নয়, এর পাশাপাশি তিনি রচনা করেছেন বিভিন্ন ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, দিনলিপি ইত্যাদি। প্রখ্যাত এই সাহিত্যিক ১৮৯৪ সালের ১২ সেপ্টেম্বর ভারতের পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগণা জেলায় জন্মগ্রহণ করেন, তবে তাঁর পৈতৃক নিবাস ছিল যশোর জেলায়। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র হিসেবে তিনি শিক্ষাজীবন অতিবাহিত করেন, যার প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁর প্রথম বিভাগে এনট্রান্স ও আইএ পাশ করার মাধ্যমে। এমনকি তিনি কলকাতার রিপন কলেজ থেকে ডিস্টিংশনসহ বিএ পাশ করেন। সাহিত্য রচনার পাশাপশি তিনি শিক্ষকতার মাধ্যমে কর্মজীবন অতিবাহিত করেন। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমূহ এর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হলো 'পথের পাঁচালী', যা দেশ ছাড়িয়ে বিদেশের মাটিতেও ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হওয়ার মাধ্যমে। এই উপন্যাস অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মাণ করে প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় অর্জন করেছেন অশেষ সম্মাননা। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই এর মধ্যে আরো উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো 'আরণ্যক', 'অপরাজিত', 'ইছামতি', 'আদর্শ হিন্দু হোটেল', 'দেবযান' ইত্যাদি উপন্যাস, এবং 'মৌরীফুল', 'কিন্নর দল', 'মেঘমল্লার' ইত্যাদি গল্পসংকলন। ১০ খণ্ডে সমাপ্ত ‘বিভূতি রচনাবলী’ হলো বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমগ্র, যেখানে প্রায় সাড়ে ছ’হাজার পৃষ্ঠায় স্থান পেয়েছে তার যাবতীয় রচনাবলী। খ্যাতিমান এই সাহিত্যিক ১৯৫০ সালের ১ নভেম্বর বিহারের ঘাটশিলায় মৃত্যুবরণ করেন। সাহিত্যে অসামান্য অবদানের জন্য তিনি মরণোত্তর 'রবীন্দ্র পুরস্কারে' ভূষিত হন।