বহু বছর আগে প্রাগে এক গোরখোদক ছিল। জুয়াড়ি। এক সময় শহরে হানা দেয় মহামারি। মহামারির তোপে জনশূন্য শহর। অভাব পড়ল গোরখোদকের জুয়াখেলার পার্টনারেরও। জুয়ার নেশায় পাগলপ্রায় গোরখোদক একপর্যায়ে প্রার্থনায় তার নিজের আত্মার বিনিময়ে একজন জুয়াড়ি বন্ধুর প্রাণ ফেরত চায়। শয়তানের কানে যায় একথা। শয়তান তার এক বন্ধুর ছদ্মবেশে আসে। শুরু হয় জুয়াখেলা। সারারাত ধরে খেলার পর প্রত্যুষে সেই শয়তান বন্ধুটি স্বরূপে ফিরে গোরখোদকের ঘাড় মটকে দেয়। বেচারার অপঘাতে মৃত্যু হয়। এরপর থেকে কবরস্থানে এই জুয়াড়ি গোরখোদকের অতৃপ্ত আত্মা সারারাত ভর কবর খুড়ে চলে। আর অপেক্ষা করে যদি কেউ তাঁর সঙ্গে একটিবার জুয়া খেলতে আসে। এরকম অসংখ্য ভূতাশ্রিত গল্পের রটনা রয়েছে প্রাগ শহরকে ঘিরে। এইদিক থেকে প্রাগকে ঘিরে উপলব্ধ হবে একটা গা ছমছমে ভাব। অন্যদিকে প্রাগ শহর আশ্চর্য এক শিল্পনগরী। এখানেই ফ্রানৎস কাফকার জন্ম। আদিবাড়ি। তাঁর জন্মস্থানটা এখন ফ্রানৎস কাফকা স্কয়ার। এই শহরেই তাঁর মিউজিয়াম। মিউজিয়ামে কাফকার প্রায় সমস্তগ্রন্থের প্রথম কপিসমেত ডায়েরি, অজস্র চিঠিপত্রের বিরল ভাণ্ডার সংরক্ষিত রয়েছে। শহরে রয়েছে কাফকার ভাস্কর্য। কাফকার নামে একটা বুকশপের নাম 'ফ্রানৎস কাফকি'। আর্ট গ্যালারি। আর তাঁর অনন্তলোকের সমাধিস্থল। এই শহরের ওল্ড টাউন কয়ারে ছিল আইনস্টাইনের অবাধ বিচরণ। লুভ ক্যাফেতে সান্ধ্যকালীন আড্ডায় বসতেন নানান শিল্প সমঝদারেরা। কুচিৎ-কদাচিৎ মুখোমুখি বসেছেন কাফকা আর আইনস্টাইনও। হুসোভা স্ট্রিটে একপাশের তিনতলা উঁচু ছাদের দিকে তাকালে হঠাৎ কেউ হকচকিয়ে উঠতে পারেন এই ভেবে যে, এই বুঝি কেউ ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে স্বেচ্ছামৃত্যু বেছে নিচ্ছে। দালান থেকে একটা লম্বা রড বেরিয়ে এসেছে রাস্তার দিকে। রডের অগ্রভাগে লোকটা ঝুলন্ত। পরনে স্যুট, ওয়েস্ট কোট, পায়ে জুতা। এই লোকটাই সিগমুন্ড ফ্রয়েড। চিরসমকালীন, অবিসংবাদিত স্বপ্নদ্রষ্টার শূন্যে ভাসমান ভাস্কর্য প্রতিমুহূর্তে পর্যটকদের প্রশ্ন করছে। জীবদ্দশাতেও যিনি অজস্র প্রশ্ন রেখে গেছেন আপামর কৌতূহলী মানুষের কাছে। এই শহরেই একটা দেয়াল আছে জন লেননের। প্রতিদিন নানা রঙে বিদগ্ধ টানটোনে গ্রাফিটি এঁকে প্রতিবাদ রাখে পূর্ণপ্রাণ অভ্যাগতরা। প্রাগে দুইবারের মতন পা ফেলেছেন রবীন্দ্রনাথ। রয়েছে অ্যাস্ট্রনমিক্যাল ঘড়ি। চার্লস ব্রিজ। লেখক তাঁর পরিভ্রমণের সাথে যেন পাঠককেও সংলিপ্ত করেছেন আপন শিল্পচৈতন্যের আলোকে। পড়ে মনে হবে, কিছুক্ষণের জন্য প্রাগেই চলে এলাম। 'কাফকার প্রাগ- সত্যরে আমি কোথায় লুকাই', লেখকের এই আত্মসংবৃত প্রশ্ন যেন যথার্থই। একলহমায় একখণ্ড প্রাগের প্রাণস্পর্শ কেই বা হাতছাড়া হতে দিতে চায়?
বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী মাহফুজুর রহমান ছিলেন একজন পেশাদার কূটনীতিক। তিনি পোল্যান্ড, ইউক্রেন ও মলডোভায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ছিলেন। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় হতে স্থাপত্যে স্নাতক এবং অস্ট্রেলিয়ার মনাশ বিশ্ববিদ্যালয় হতে কূটনীতি ও আন্তর্জাতিক অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। এছাড়া হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়, মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও হাওয়াইয়ের এশিয়া প্যাসিফিক সেন্টারে নিরাপত্তা ও শান্তি বিষয়ে একাধিক কর্মশালা ও অনুশীলন সমাপ্ত করেছেন। ময়মনসিংহ জিলা স্কুল ও মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজের ছাত্র তিনি। জন্ম ১৯৬১ সালে। দেশে ও বিদেশে বিভিন্ন পত্রিকা, সাময়িকী ও গবেষণা সাইটে আন্তর্জাতিক রাজনীতি, নিরাপত্তা ও কূটনীতি নিয়ে যেমন লিখেছেন, তেমনি লিখে চলছেন নন্দনতত্ত্ব ও চিত্রশিল্প নিয়ে নিবন্ধ কিংবা ভ্রমণকাহিনি। বিচিত্র সব উপাদানে তাঁর ভ্রমণকাহিনি উপভোগ্য হয়ে ওঠে। তাঁর গদ্যশৈলী সহজ ও সাবলীল।