‘রেনেসাঁস রমণী’ ওয়েন্ডি ডনিগারের গবেষণা মূলত দুটো প্রধান অক্ষকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে: হিন্দুধর্ম আর পুরাণকথা। কিন্তু এর বাইরেও তাঁর বিশেষজ্ঞতার প্রশস্ত বর্ণালী চোখ ঝলসে দেয়। স্তালিনপন্থী মা আর উদারপন্থী বাবার কন্যা, একদা ব্যালেরিনা হতে-চাওয়া এই ইহুদি সংস্কৃত স্কলার ১৯৬০-এর দশকে বাইশ বছর বয়সে হার্ভার্ড থেকে কলকাতা ও শান্তিনিকেতনে এসেছিলেন গবেষণার কাজে। শান্তিনিকেতনে জ্যোৎস্নারাতে সবার সঙ্গে তিনিও যেতেন বনে, তিনিও আকাশ ভরতেন গানে, নাচতেন মণিপুরী। দারিদ্র্য-আকীর্ণ কলকাতায় রবি শঙ্করের উচ্ছলতা আর আলি আকবরের আত্মমগ্নতা তাঁর সামনে খুলে দিত স্বর্গের নূতন নূতন দ্বার। যামিনী রায় খুলে দিতেন পটচিত্রের ভাণ্ডার। মাকে লেখা তাঁর চিঠিগুলিতে সেইসব টাটকা অভিজ্ঞতার অলৌকিক উন্মোচন ঘটেছিল।আজ অশীতিপর ওয়েন্ডির এই স্মৃতিচারণ হাওয়ায় ছড়িয়ে দিয়েছে অধরা এক ব্যাকুলতা।একদিকে ইতিহাস, পুরাণ, রাজনীতি, সাহিত্য, সংগীত, অন্যদিকে ব্যক্তিগত আনন্দবেদনার এ এক অভাবনীয় উদ্ভাস।তাঁর চোখ দিয়ে আমরাও আমাদের নতুন করে চিনছি।বাংলায় এই অকুতোভয় বিদুষীর বই এই প্রথম অনুবাদ হল।
‘‘বিশ্বের বিদ্বৎসমাজে ও ভারতবিদ্যাচর্চার ক্ষেত্রে অধ্যাপিকা ডনিগার যে একজন অগ্রণীর ভূমিকায় থেকেছেন,এ নিয়ে তর্কের অবকাশ নেই।ভারতবর্ষেও তাঁর বহু অনুরাগী পাঠক-পাঠিকা আছেন,যাঁরা এই বইয়ের প্রকাশনায় আন্তরিকভাবে খুশি হবেন।স্মৃতি,নানান-রসে-জারানো জীবনবোধ ও বিশ্লেষণী বুদ্ধির একত্র সহবাস তাঁর গদ্যে।অনুবাদকের গুণে ভাষান্তরে তা একটুও মলিন হয়নি।আমরা যেমন পৃথিবীর অন্য অঞ্চল চিনতে গিয়ে নিজেদের নতুন করে দেখতে পাই,পাশ্চাত্যের পণ্ডিতেরাও তেমন আমাদের চিনতে গিয়ে নিজেদের তুলনামূলকভাবে চেনেন।বিভিন্ন সভ্যতার মধ্যে আদান-প্রদানের মূল কথা এইটাই: নিজের বাইরে না গেলে নিজেকে জানা হয় না।আর এই জানারও কোনো শেষ নেই।সেই কারণেই হয়তো এই বইটি পড়ার পরও রবীন্দ্রনাথের সেই লাইনটিই আবার মনে পড়ে,‘আপনাকে এই জানা আমার ফুরাবে না’।তার সঙ্গে এ-সত্যও স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে,আধুনিক লেখাপড়ার গোড়ায় রয়েছে এই বিশ্বনাগরিকতার অনুসন্ধান।সেই কারণেই ভিনদেশি গবেষকদের মধ্যে বন্ধুত্ব, সই-পাতানো, অন্তরঙ্গতা যেসব গল্পকথা এই বইয়ের পাতায় পাতায় ছড়িয়ে আছে।’’