রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অধ্যাত্মমুখীন কাব্যচিন্তার প্রভাব থেকেই তাঁর দ্বিতীয় অর্থাৎ শান্তিনিকেতন পর্বের নাটক রচনার সূত্রপাত। এই পর্বের নাটকে ‘ব্যক্তি আমি’ বিশ্বমানবে পরিণত। ব্যক্তির সীমা অতিক্রম করে রবীন্দ্রনাট্য চেতনা তখন ব্যক্তির বৃহত্তর জীবনে প্রতিস্থাপিত। আর এই অতীন্দ্রিয় অধ্যাত্ম ভাবকে পরিবেশন করার জন্য তিনি সংগীতের অনুগামী হয়েছেন। তাই এ পর্বের নাটকের মধ্যে গানের প্রতিফলন অনেক বেশি। রূপক সংকেতের দ্বারা সেই অধ্যাত্মলোকের তত্ত্বকে মানবজীবনের মধ্যে দিয়ে রূপায়িত করে দেখানোর জন্যই এই সংগীতের প্রয়োগ। নাটকে যে কথা ‘ব্যক্তি আমি' 'বৃহত্তর মানবগোষ্ঠী' বলতে পারেনা, তা অনায়াসে বলে দেয় সংগীত | সেক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের তত্ত্বমূলক নাটকে সংগীতের প্রয়োগ তাৎপর্যপূর্ণ। ‘রাজা’ নাটকও রবীন্দ্রনাথের দ্বিতীয় পর্যায়ের নাট্যপর্বে একটি তত্ত্বমূলক নাটক। এই নাটকখানি ‘গীতাঞ্জলি’র সাংগীতিক সৃষ্টিপর্বে (১৯১০খ্রি.) রচিত। ‘রাজা’ নাটকে নাট্যকার গান দিয়েই কাহিনিকে গ্রন্থনা করেছেন। মানুষ ও স্রষ্টার মিলিত পূর্ণসত্তাই রাজার সত্তা। রবীন্দ্র বীক্ষণাগারে বিশেষ রূপ আর বিশ্বরূপে মিলিত সত্তা রাজা । ‘রাজা’র রূপই মানুষের স্বরূপ। প্রকৃতপক্ষে সীমার সঙ্গে অসীমের, রূপের সঙ্গে অরূপের মিলনতত্ত্বই এখানে রূপায়িত । এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ তার ‘রাজা’ নাটকে বৈষ্ণব অনুষঙ্গও এনেছেন। রবীন্দ্রচেতনায় সারাজীবন যে ‘ছোট আমি’-র সঙ্গে ‘বড় আমি’-র মিলন কাজ করেছে তাই ‘রাজা’ নাটকে উপস্থাপিত। রবীন্দ্রনাথের মধ্যে আজীবনব্যাপি প্রেমের যে ত্যাগ ও কল্যাণময় চেতনা, মঙ্গলময় অনুভূতি কাজ করে আসছিল—যা ছিল বৌদ্ধ ধর্ম প্রভাবিত –সেই চিন্তা চেতনার—সফল নাট্যরূপ ‘রাজা'। এ নাটকেই কাহিনি অংশেও তাই রয়েছে ‘বৌদ্ধ অবদান’ সাহিত্যের প্রভাব। প্রেমের পূর্ণতা ভোগে নয়, ত্যাগে, প্রেমের মূর্তি, মঙ্গলের মূর্তি; প্রেমের উত্তরণ অন্ধকার কক্ষ থেকে আলোকময় উজ্জ্বলকিরণে—এই ভাবনাই সামগ্রিক রবীন্দ্রসাহিত্য কর্মে রূপায়িত। রবীন্দ্র জীবনদর্শনও এই বোধে বিশ্বাসী। তাঁর চেতনাময় ভক্ত ভগবানের প্রেমময় মিলন—যা বৈষ্ণবতত্ত্বের প্রধান অঙ্গ, তা-ই বড় রূপে বিরাজিত। সমস্ত প্রকার ক্ষুদ্রত্ব, তুচ্ছতার ঊর্ধ্বে সেই পরম পুরুষের সঙ্গে মিলনের আকাঙ্ক্ষাই রবীন্দ্রজীবনের মূল দর্শন। ‘রাজা’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এক ভাবতত্ত্বমূলক নাটক। ‘রাজা’ রচনার সময় থেকেই রবীন্দ্রমানস পরিবর্তন হচ্ছিল। ‘রাজা’ নাটকের সমস্যায় আছে প্রেমের দহন ও দীপ্তি। রাজার ইংরেজী অনুবাদ “The king of dark chamber' । 'রাজা' নাটকে রাজা ও রাণী সুদর্শনার বিরহ মিলনের ব্যাপারকে বৈষ্ণবভাবনায় কৃষ্ণ-রাধার অভিসারের প্রতিরূপক বলা যায়। সীমার সঙ্গে অসীমের মিলন, রূপের সঙ্গে অরূপের এ ভাবনা রবীন্দ্র জীবনদর্শনের ভিত্তি। অসীমের প্রকাশ রূপে ও অরূপে -এ তত্ত্বই 'রাজা' নাটকে প্রকাশিত। - রবীন্দ্রনাথের ‘রাজা’ নাটকের প্রকাশকাল ১৯১০ খ্রিস্টাব্দ, গীতাঞ্জলি-গীতিমাল্য- গীতালির যুগে রচিত হয় এই সাংকেতিক নাটক। ১৩১৭ বঙ্গাব্দের শ্রাবণ মাসে গীতাঞ্জলি প্রকাশিত হয় । সেই বছরের পৌষ মাসে প্রকাশিত হয় ‘রাজা’ । ক্ষণিকা'র পর থেকেই রবীন্দ্রনাথের কাব্যজীবনের একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়, ‘খেয়া’
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম ১৮৬১ সালের ৭ মে (২৫ বৈশাখ ১২৬৮) কলকাতার জোড়াসাঁকোয়। বাবা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ। বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ ভারতীয় মনীষী এবং বিশ্ববিখ্যাত কবি। ছাপার অক্ষরে স্বনামে তাঁর প্রথম প্রকাশিত কবিতা ‘হিন্দু মেলার উপহার’ (৩০.১০.১২৮১ ব.)।
১৮ বছর বয়সের মধ্যে তিনি ‘বনফুল’, ‘কবিকাহিনী’, ‘ভানুসিংহের পদাবলী’, ‘শৈশব সংগীত’ ও ‘রুদ্রচণ্ডু’ রচনা করেন। ‘জ্ঞানাঙ্কুর’ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘ভুবনমোহিনী প্রতিভা’ তাঁর প্রথম গদ্য প্রবন্ধ। ‘ভারতী’র প্রথম সংখ্যায় তাঁর প্রথম ছোটগল্প ‘ভিখারিণী’ এবং প্রথম উপন্যাস ‘করুণা’ প্রকাশিত হয়। ২২ বছর বয়সে নিজেদের জমিদারি সেরেস্তার এক কর্মচারীর একাদশবর্ষীয়া কন্যা ভবতারিণীর (পরিবর্তিত নাম মৃণালিনী) সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয় (৯.১২.১৮৮৩)। পুত্র রথীন্দ্রনাথের শিক্ষা-সমস্যা থেকেই কবির বোলপুর ব্রহ্মচর্য আশ্রমের সৃষ্টি হয় (২২.১২.১৯০১)। সেই প্রতিষ্ঠানই আজ ‘বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়’-এ রূপান্তরিত হয়েছে।
১৯১২ সালের নভেম্বর মাসে গীতাঞ্জলির ইংরেজি অনুবাদ বা ‘ঝড়হম ঙভভবৎরহমং’ প্রকাশিত হয়। ১৯১৩ সালের অক্টোবরে প্রথম ভারতবাসী রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডক্টরেট (১৯১৪) এবং সরকার স্যার (১৯১৫) উপাধিতে ভূষিত করে।
রবীন্দ্রনাথের একক চেষ্টায় বাংলাভাষা সকল দিকে যৌবনপ্রাপ্ত হয়ে বিশ্বের দরবারে সগৌরবে নিজের আসন প্রতিষ্ঠা করেছে। কাব্য, ছোটগল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ, গান প্রত্যেক বিভাগেই তাঁর অবদান অজস্র এবং অপূর্ব। তিনি একাধারে কবি, দার্শনিক, শিক্ষাবিদ, সুরকার, নাট্যপ্রযোজক এবং স্বদেশপ্রেমিক। তাঁর রচিত দুই হাজারের ওপর গানের স্বরলিপি আজো প্রকাশিত হচ্ছে। দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের (ভারত ও বাংলাদেশ) জাতীয় সংগীত-রচয়িতারূপে একমাত্র রবীন্দ্রনাথেরই নাম পাওয়া যায়।