রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১) বিশ্বপ্রতিভার এক বৈচিত্র্যময় বিস্ময়। গ্রন্থস্থিত দশটি প্রবন্ধের ‘স্বদেশী সমাজ' নির্ভর দুটো প্রবন্ধ ও ‘সভ্যতার সংকট’ বাদে বাকি সাতটিই মূরত শিল্প-সাহিত্যভিত্তিক রচনা। সংকলিত প্রবন্ধগ্রন্থে রবীন্দ্রনাথের সমাজ-রাজনীতি ও সভ্যতার চিন্তাসমেত সাহিত্য ও নন্দনতাত্ত্বিক ভাবনরাজি পরিস্ফুট হয়েছে। কারিদাসের ‘মেঘদূত' কাব্য প্রেমের বিরহের এক চূড়ান্ত শিল্পস্পর্শী অবস্থানে উন্নীত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের 'মেঘদূত' নামে কবিতাও আছে। রবীন্দ্রনাথের ‘মেঘদূত' প্রবন্ধও মূরত প্রেম, সৌন্দর্য, বিরহ নিয়ে আবর্তিত; যা কালিদাসের প্রেম-বিরহের বিষয়বস্তু নিয়েই চক্রাবর্তিত। মেঘকে দূত করে প্রেমের বার্তা পাটানোর মধ্যে প্রেমিক-প্রেমিকার পারস্পরিক প্রেম ও বিরহবোধের যে তীব্রতা প্রতিভাত হয়-তা শির্পের এক তুঙ্গস্পর্শী উচ্চতা। রবীন্দ্রভাষ্য স্মর্তব্য : 'কিন্তু কেবল অতীত বর্তমান নহে, প্রত্যেক মানুষের মধ্যে অতলস্পর্শ বিরহ। রবীন্দ্রনাথের ‘সৌন্দর্যের সম্বন্ধ' প্রবন্ধ নন্দনতত্ত্বের গভরিতাসম্পৃক্ত একটি উৎকৃষ্টমানের রচনা। প্রবন্ধটির মৌল-ভাষ্য রবীন্দ্র-উদ্ধৃতিতেই স্মর্তব্য : “পৃথিবী হইতে সমস্ত জীবন যে নিরুপম সৌন্দর্য চয়ন করিতে পারিয়াছি যাইবার সময় যেন একখানি পূর্ণ শতদলের মতো সেটি হাতে করিয়া লইয়া যাইতে পারি এবং যদি আমার প্রিয়তমের সহিত সাক্ষাৎ হয় তবে তাহার করপল্লবে সমর্পণ করিয়া দিয়া একটিবারের মানবজন্ম কৃতার্থ করিতে পারি।” মানুষ প্রতিদিনের কর্ম-ব্যস্ততার মাঝে জীবন ও জগতের সৌন্দর্যকে অনুভব করার মানসিকতা পোষণ করলে তার যাপিত জীবন সুখকর হবে। 'সৌন্দর্যের সম্বন্ধ’ এভাবে জীবনের সাথে ব্যাপকভাবে সম্পর্কিত। জীবনে যেহেতু উচ্চ ও নিচতার বিষয় আছে—'সেজন্য এক মানুষের হীনতাবোধের কারণেষ অন্য মানুষ কষ্ট পেতে পারে। জীবন তখন দুর্বহ হয়ে উঠে। জীবন সম্পর্কে ইতিবাচক সৌন্দর্যচিন্তা সে দুঃখকে লাঘব করতে পারে। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন : 'আত্মার কার্য আত্মীয়তা করা।' আত্মা ‘বিসদৃশকে সদৃশ, দূরকে নিকট পরকে আপনার করিতেছে।' ... আত্মা দিয়েই সৌন্দর্যকে অনুভব করতে হয়। সেজন্য আত্মাকে স্বচ্ছ, পবিত্র ও লক্ষ্যভেদী রাখতে হয়। মিলনের আধ্যাত্মিকতা'কে আত্মা পরিপূর্ণতা বিধান করে।'
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম ১৮৬১ সালের ৭ মে (২৫ বৈশাখ ১২৬৮) কলকাতার জোড়াসাঁকোয়। বাবা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ। বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ ভারতীয় মনীষী এবং বিশ্ববিখ্যাত কবি। ছাপার অক্ষরে স্বনামে তাঁর প্রথম প্রকাশিত কবিতা ‘হিন্দু মেলার উপহার’ (৩০.১০.১২৮১ ব.)।
১৮ বছর বয়সের মধ্যে তিনি ‘বনফুল’, ‘কবিকাহিনী’, ‘ভানুসিংহের পদাবলী’, ‘শৈশব সংগীত’ ও ‘রুদ্রচণ্ডু’ রচনা করেন। ‘জ্ঞানাঙ্কুর’ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘ভুবনমোহিনী প্রতিভা’ তাঁর প্রথম গদ্য প্রবন্ধ। ‘ভারতী’র প্রথম সংখ্যায় তাঁর প্রথম ছোটগল্প ‘ভিখারিণী’ এবং প্রথম উপন্যাস ‘করুণা’ প্রকাশিত হয়। ২২ বছর বয়সে নিজেদের জমিদারি সেরেস্তার এক কর্মচারীর একাদশবর্ষীয়া কন্যা ভবতারিণীর (পরিবর্তিত নাম মৃণালিনী) সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয় (৯.১২.১৮৮৩)। পুত্র রথীন্দ্রনাথের শিক্ষা-সমস্যা থেকেই কবির বোলপুর ব্রহ্মচর্য আশ্রমের সৃষ্টি হয় (২২.১২.১৯০১)। সেই প্রতিষ্ঠানই আজ ‘বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়’-এ রূপান্তরিত হয়েছে।
১৯১২ সালের নভেম্বর মাসে গীতাঞ্জলির ইংরেজি অনুবাদ বা ‘ঝড়হম ঙভভবৎরহমং’ প্রকাশিত হয়। ১৯১৩ সালের অক্টোবরে প্রথম ভারতবাসী রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডক্টরেট (১৯১৪) এবং সরকার স্যার (১৯১৫) উপাধিতে ভূষিত করে।
রবীন্দ্রনাথের একক চেষ্টায় বাংলাভাষা সকল দিকে যৌবনপ্রাপ্ত হয়ে বিশ্বের দরবারে সগৌরবে নিজের আসন প্রতিষ্ঠা করেছে। কাব্য, ছোটগল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ, গান প্রত্যেক বিভাগেই তাঁর অবদান অজস্র এবং অপূর্ব। তিনি একাধারে কবি, দার্শনিক, শিক্ষাবিদ, সুরকার, নাট্যপ্রযোজক এবং স্বদেশপ্রেমিক। তাঁর রচিত দুই হাজারের ওপর গানের স্বরলিপি আজো প্রকাশিত হচ্ছে। দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের (ভারত ও বাংলাদেশ) জাতীয় সংগীত-রচয়িতারূপে একমাত্র রবীন্দ্রনাথেরই নাম পাওয়া যায়।