আইয়ুবশাহীর গণবিরোধী শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে বাষট্টি সালে কুমিল্লায় গ্রেফতার হন তৎকালীন ছাত্রনেতা গাজীউল হাসান খান। সেই থেকে রাজনৈতিক কারণেই ক্রমশ সাংবাদিকতার দিকে ঝুঁকে পড়েন তিনি।
ষাটের দশকের পরবর্তী সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে এম এ এবং সাংবাদিকতায় উচ্চতর ডিপ্লোমা করার সময় তৎকালানী পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন) ও বাংলা ছাত্র ইউনিয়নের যথাক্রমে সহ-সভাপতি এবং কার্যকরী সভাপতি'র দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি তিনি সাংবাদিকতাও চালিয়ে যান। সত্তরের দিকে তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠিত 'ইস্টার্ন নিউজ এজেন্সিতে' (এনা) যোগ দেন একজন রাজনৈতিকি রিপোর্টার হিসেবে। উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে প্রথম কাতারে থেকে লড়েছেন আইয়ুব খানের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে। তারপর একাত্তরের স্বাধীনতা সংগ্রামে একজন মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রের রাজনৈতিক ভাষ্যকার হিসেবে অবদান রাখেন। সংগঠিত করেন মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প এবং সংগ্রামী ছাত্রজনতাকে।
গাজীউল হাসান খান স্বাধীনতার পরে আবার পূর্ণকালীন সাংবাদিকতায় ফিরে আসেন। সে সময় তিনি মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর তথ্য ও প্রচার বিষয়ক কর্মকান্ডের দায়িত্বে ছিলেন কমনওয়েল্থ সচিবালয়ের বৃত্তি নিয়ে ছিয়াত্তরে লন্ডনে যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত। সাংবাদিকতা ছাড়াও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে তিনি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। লন্ডনে অবস্থানকালে তিনি প্রবাসী বাংলাদেশীদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে ঊনআশি সালে তারই সম্পাদনায় 'দেশবার্তা' নামে একটি সংবাদপত্র বের করেন, যা পরবর্তীকালে বাংলাদেশের বাইরে প্রথম বাংলা দৈনিকের মর্যাদা লাভ করে। সে সময়ে তিনি প্রবাসী বাংলাদেশী শিশুদের মাতৃভাষা বাংলা শিক্ষাদানের প্রয়োজনীয় বাংলা বইপত্র প্রকাশ এবং কমিউনিটি বাংলা স্কুল (সপ্তাহান্তে) চালু করার ব্যাপারে নিরলসভাবে প্রচেষ্টা চালান। তাঁরই প্রতিষ্ঠিত কম্পিউটার কম্পোজসহ আধুনিক বাংলা মুদ্রণালয় থেকে তখন প্রকাশিত হয়েছে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বাংলা সাহিত্য সংকলন ও বইপত্র। এর পাশাপাশি তিনি ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন (বিবিসি) এবং ব্রিটিশ দৈনিক 'দ্য গার্ডিয়ানের' সাথেও সম্পৃক্ত ছিলেন একজন পেশাজীবী সাংবাদিক হিসেবে। পরে লন্ডনের ফ্লিট স্ট্রিট থেকে প্রকাশিত আন্তর্জাতিক সংবাদ ম্যাগাজিন, 'দ্য ওয়ার্ল্ড টাইমস'- এর সিনিয়র এডিটর নিযুক্ত হন।
গাজীউল হাসান খান ১৯৯৩ সালে বাংলাদেশের ওয়াশিংটনস্থ দূতবাসের প্রেস ও তথ্য মিনিস্টার হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে গমন করেন। আটানব্বই সালে তিনি স্থায়ীভাবে দেশে ফিরে আসেন এবং 'বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা'র (বাসস) প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন (২০০৩-২০০৬)।
বিলেত প্রবাসী বাংলাদেশীদের জীবন-জীবিকা নিয়ে লেখা গাজীউল হাসান খানের ভিন্নধর্মী উপন্যাস, 'বিপন্ন জনপদ' এবং তাঁর সাম্প্রতিককালে প্রকাশিত, 'ইতিহাসের অনুঘটক ও অন্যান্য', 'সময়ের সংলাপ' 'প্যালেস্টাইন: এক সংগ্রামের ইতিহাস'সহ পুস্তকগুলো পাঠকদের প্রশংসা কুড়িয়েছে। বাংলাদেশের সাংবাদিকতা, সাহিত্য ও জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণে গাজীউল হাসান খানের উদ্যম ও প্রচেষ্টা জাতীয় পর্যায়ে প্রশংসিত। সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার জনাব খানকে ২০০৬ সালে 'একুশে পদক' প্রদান করেছেন। পেশাগত ক্ষেত্রে অবদানের জন্য দেশ-বিদেশে বেসরকারী পর্যায়েও বহু পদক ও সম্মাননা লাভ করেছেন। জনাব খান ১৯৪৬ সালে কুমিল্লায় জন্মগ্রহণ করেন।