সিজার এবং রোমের কথা ও কাহিনী

সিজার এবং রোমের কথা ও কাহিনী (হার্ডকভার)

TK. 800
কমিয়ে দেখুন
tag_icon

বই ও পণ্যে ৭০% পর্যন্ত ছাড়! বছরের সেরা ডিল, রকমারি ক্লিয়ারেন্স সেল, ২০২৫

বইটি বিদেশি প্রকাশনী বা সাপ্লাইয়ারের নিকট থেকে সংগ্রহ করে আনতে আমাদের ৩০ থেকে ৪০ কর্মদিবস সময় লেগে যেতে পারে।

west-bengal-book

পাঠকেরা একত্রে কিনে থাকেন

এই ই-বুক গুলোও দেখতে পারেন

বইটই

বইটির বিস্তারিত দেখুন

মৌন অতীত কথা বলে। তার একনিষ্ঠ পূজারী ইতিহাসবিদের কাছে অনাদি অতীত ইতিহাস হয়ে নিজেকে প্রকাশ করে। পূজারীর কাছে সে গোপনচারী নয়, অচেতন‌ও নয়। পূজারীর সাধনায় সেই ইতিহাস বর্তমানেও প্রাণবন্ত সমসাময়িক হয়ে ওঠে।

ইতিহাসবিদ রজত পালের লেখা "সিজার এবং রোমের কথা ও কাহিনী" পড়তে পড়তে উপরের কথাগুলোই বারবার মনে আসছিল। এটি মূলত ইতিহাসের বই, জনশ্রুতি বা মিথ যেটুকু আছে, তা ইতিহাসের উপাদান।


বইটিকে তিনটি কালপর্বে বিভক্ত করা হয়েছে।

১। রোম প্রতিষ্ঠা ও রাজতন্ত্র- 753 BC - 509 BC

২। প্রজাতন্ত্র ও সিজার- 509 BC - 27 BC

৩। সম্রাট যুগ- 27 BC - 476 AD

তবে প্রদীপ জ্বালানোর আগে যেমন সলতে পাকানোর ইতিহাস থাকে, তেমন এখানেও লেখক রোম প্রতিষ্ঠার পূর্বের অতিকথননির্ভর ইতিহাসেও আলোকপাত করেছেন। ক'জন‌ই বা জানেন যে হারকিউলিস ‌এক ঐতিহাসিক চরিত্র‌ এবং রোম প্রতিষ্ঠার বহু পূর্বেই তিনি এই অঞ্চলে এসেছিলেন? লেখক এখানে জানিয়েছেন যে হারকিউলিস তার দশম অভিযানে বর্তমান স্পেনে এসেছিলেন। সেখানে পশুপালক গেরিয়নকে হত্যা করে তার পশুর পাল নিয়ে গ্রিসে ফেরার পথে হারকিউলিস ইতালির aventine পাহাড়ে আসেন। যে সাতটি পাহাড় নিয়ে রোম নগরী গড়ে উঠেছিল এটি তাদের মধ্যে একটি। এখানে হারকিউলিস -এর একটি ঘটনার সঙ্গে মহাভারতের ভীমের জীবনের একটি ঘটনার মিল পাওয়া যায়। লেখক ইতিহাস মন্থন করে দেখিয়েছেন হারকিউলিসের সময় আনুমানিক 1260 BC. রোমান সভ্যতার সঙ্গে হারকিউলিসের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল, মার্ক এন্টনি হারকিউলিসের পুজো করতেন। লেখক যথার্থই বলেছেন, "সঠিক প্রমাণ না থাকায় একজন ঐতিহাসিক চরিত্র কালের স্রোতে মিথলজিক্যাল হয়ে উঠলেন"। ভারতের পৌরাণিক কিছু চরিত্রের ক্ষেত্রেও এ কথা প্রযোজ্য।

এরপর আসে রমুলাসের জন্মের কাহিনী। ট্রয়ের যুদ্ধের পর ট্রয় থেকে ইটালিতে পালিয়ে এসে ইনিয়াস "আলবা লোঙ্গা" অঞ্চল স্থাপন করেন, পরবর্তীকালে এর‌ই নিকটবর্তী অঞ্চলে রোম নগরী স্থাপিত হয়। ইনিয়াসের পরবর্তী প্রজন্মের এক রাজার মেয়ে ছিলেন রিয়া সিলভিয়া। তাকে জোর করে ভেস্টাল ভার্জিন বানানো হয়। ভেস্টাল ভার্জিনদের চিরকুমারী থাকতে হতো । কিন্তু কুমারী সিলভিয়ার গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন রোম নগরীর প্রতিষ্ঠাতা রোমুলাস এবং তার জমজ ভাই রেমাস। রাজা এই দুই জমজ শিশুকে নদীতে ফেলে দেবার আদেশ দেন। কিন্তু বিধির বিধান ছিল অন্যরকম। সেও এক সুন্দর মিথ। দায়িত্বপ্রাপ্ত রক্ষী শিশু দুটিকে একটি ঝুড়িতে রেখে এক ডুমুর গাছের নিচে রেখে আসে। একটি মা নেকড়ে, যার নাম লুপা, শিশুদুটিকে নিজের গুহায় এনে বাঁচিয়ে রাখে। ফস্টুলাস নামে এক মেষপালক লুপার গুহা থেকে শিশুদুটিকে নিয়ে আসে এবং প্রতিপালন করে। রোমুলাসের জন্ম ও লুপা কর্তৃক প্রতিপালন নিয়ে যাবতীয় মিথ লেখক যথেষ্ট যুক্তি সহ বিশ্লেষণ করেছেন রোমুলাসের অধ্যায়ে।


প্রথম রাজতন্ত্র( 753 BC - 509 BC ):

"রোম ওয়াজ নট বিল্ট ইন এ ডে"- আমাদের ছোটবেলায় ইংরেজি ব্যাকরণ বইতে এই কথাটা ছিল। কতদিনে যে নির্মাণ হয়েছিল ব্যাকরণ বই তা আমাদের জানাতো না। কিভাবে হয়েছিল তা তো নয়ই। "সিজার এবং রোমের কথা ও কাহিনী" পড়ে তা জেনে অবাক হলাম। খ্রিস্টপূর্ব ৭৫৩ সাল থেকে ৪৭৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বারোশো বছরের‌ও বেশী বিশাল সময় নিয়ে রোম সাম্রাজ্যের উত্থান, উন্নতি, প্রতিষ্ঠালাভ এবং পতন। প্যালাটাইনে রোমুলাসের নেতৃত্বে নগর রাজ্য রোমের প্রতিষ্ঠা হয়। প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র হয়ে ওঠার আগে রমুলাস থেকে টারকুইনাস মোট সাত জন রাজা রোম শাসন করেন। স্বৈরাচারী রাজা রমুলাস গুপ্তহত্যার শিকার হন। এরপর সিনেটসভা রাজা নির্বাচন করতে না পেরে প্রজাদের হাতে রাজা নির্বাচনের ভার দেয় ।প্রজাদের দ্বারা নির্বাচিত রাজা হন নুমা পম্পেলিয়াস।

আমার ধারনায় এই সাত জন রাজার মধ্যে নুমা ছিলেন শ্রেষ্ঠ রাজা। সাধু প্রকৃতির, জ্ঞান সাধক নুমা প্রথমে রাজা হতে চাননি। মানুষের অনুরোধে তিনি রাজ্যভার গ্রহণ করেন। তার সম্পর্কিত মিথটি বড় সুন্দর। তিনি বলি প্রথা বন্ধ করেন। পরে সেই প্রসঙ্গে আসবো। তার শাসনকালে তিনি অহিংস নীতি অবলম্বন করেছিলেন বলা যায়। পার্শ্ববর্তী নগর রাজ্যগুলোর সঙ্গে যুদ্ধবিগ্রহ করেননি, পক্ষান্তরের শান্তি ও সম্প্রীতির সম্পর্ক রাখার চেষ্টা করে গেছেন।

নুমার মৃত্যুর পর রাজা হন টুল্লাস হোস্টিয়ালিস। ইনি এক জাঁহাবাজ, নুমার বিপরীত চরিত্রের রাজা ছিলেন। অন্যান্য নগর রাষ্ট্রের ওপর রোমের প্রভুত্ব বিস্তারের জন্য সর্বদাই সচেষ্ট থাকতেন। এর শাসনকালে একটি অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছিল -- দেশের আইন ব্যবস্থা অনুযায়ী দেশের শ্রেষ্ঠ বিজয়ী বীর হোরাসিয়াসকে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়। হোরাসিয়াস তখন জনতার দরবারে আপিল করেন। জনতার বিচারে মৃত্যুদণ্ড রহিত হয়ে হোরাসিয়াসের শাস্তি খুব লঘু হয়ে যায়। (আহা, আমাদের দেশে যদি এখন এমন ব্যবস্থা থাকত! কত নিরপরাধ, মানবতাবাদী মানুষ বেঁচে যেতেন।)

ষষ্ঠ রাজা, দাসীপুত্র সার্ভিয়াস ছিলেন সমাজ সংস্কারক, সুশাসক। সাধারণ মানুষের জন্য কিছু উল্লেখযোগ্য নতুন ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন। যে তিন গোষ্ঠীর মানুষেরা রোমের পত্তন করেছিলেন, তাদের বংশধররা প্যাট্রিসিয়ান। এরা ছিলেন বিশেষ সুবিধাভোগী শ্রেণী। সাধারণ নাগরিকেরা ছিলেন প্লেবিয়ান। সার্ভিয়াস প্লেবিয়ানদের ভোটের অধিকার দেন, রোমের জনগণনা করান এবং ধনীদের থেকে উদ্বৃত্ত জমি নিয়ে জমিহীনদের মাঝে ভাগ করে দেন। শর্ত সাপেক্ষে যুদ্ধবন্দী দাসেদের মুক্তির ব্যবস্থা করেন। এমন ভালো শাসকের অন্তিম পর্ব অতি করুণ। তারই বড় জামাই লুসিয়াস নিজের দল নিয়ে সিনেটের মধ্যে সারভিয়াসকে প্রচন্ড অপমান করে এবং সিনেট থেকে টেনে বাইরে নিয়ে গিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলে। আশ্চর্য এই যে, বাধা দিতে কেউ এগিয়ে আসেনি। অসংগঠিত জনতা সর্বত্রই অসহায়, তার মতামতের কোন মূল্য নেই।

এই লুসিয়াস‌ই রোমের শেষ রাজা, টার্কুইনিয়াস সুপারবাস নামে পরিচিত ইতিহাসে। এই অত্যাচারী প্রতিক্রিয়াশীল রাজা পূর্ববর্তী রাজার সংস্কারমূলক কাজগুলোকে বাতিল করে দিলেন। বহু সেনেটারকে হত্যা করেন। তার পুত্র একটি ধর্ষণকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে। সেই মহিলা আত্মহত্যা করেন। দেশে আগুন জ্বলে ওঠে।

এই লুসিয়াস টারকুইনিয়াসের একজন বোন ছিলেন, নাম টার্কুইনিয়া। এই মহিলার পুত্রের নাম ছিল লুসিয়াস জুনিয়াস। এর নামের সঙ্গে পরে ব্রুটাস শব্দটা যোগ হয়। এই লুসিয়াস জুনিয়াস ব্রুটাস হলেন রোমে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নেতৃস্থানীয়, টারকুইনাসের শাসন উচ্ছেদ করার প্রধান কারিগরদের একজন। এঁর‌ই বংশধর মার্কাস ব্রুটাস ভবিষ্যতে রোমে রাজতন্ত্র ফিরিয়ে আনার জন্য পরোক্ষে দায়ী।


প্রজাতন্ত্র ও সিজার (509 BC - 27 BC ) :

টার্কুইনাসকে ক্ষমতাচ্যুত করার পরে রোমের অধিবাসীরা স্থির করে যে রাজতন্ত্র আর নয়, এবার সিনেট সরাসরি শাসন করবে। যেহেতু সেনেটাররা জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধি, তাই এই শাসনব্যবস্থাকে প্রজাতন্ত্র বলা হয়।

প্রজাতন্ত্র যে কতখানি সম্প্রসারণবাদী, আগ্রাসী হতে পারে, রোমের ইতিহাস তার জ্বলন্ত প্রমাণ।( বর্তমানের গণতান্ত্রিক সম্প্রসারণবাদের সঙ্গে তুলনীয়। ) প্রজাতান্ত্রিক শাসনে যুদ্ধের পর যুদ্ধ করে নগর রাষ্ট্র রোমের শাসন ক্রমশ সমগ্র ইতালিতে তথা ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। স্পেন গ্রীস গল সব রোমের অধীনে আসে। ইউরোপ ছাড়িয়ে আফ্রিকা এশিয়াতেও রোমান সাম্রাজ্যের বিস্তার হয়। এই যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ শাসক নিঃসন্দেহে জুলিয়াস সিজার। রোমান সাম্রাজ্যকে তিনি অনন্য উচ্চতায় আসীন করেন। বিজিত দেশগুলির লুণ্ঠিত সম্পদে রোমের সুখ সমৃদ্ধি সম্পদ অসাধারণ মাত্রায় বৃদ্ধি পায়। স্বাভাবিকভাবেই সিজার নাগরিকদের কাছে অসম্ভব প্রিয় শ্রদ্ধার পাত্র হয়ে ওঠেন, যার ফলে সিনেটের অন্যান্য বহু সদস্য তার প্রতি ঈর্ষাকাতর হয়ে ওঠেন এবং তাকে ক্ষমতাচ্যুত করার চক্রান্ত শুরু হয়। শেষ পর্যন্ত তাকে হত্যাও করা হলো সিনেটের মিটিংয়ে। এই বিষয়গুলি রজত পাল তার এই বইটিতে হৃদয়গ্রাহী ভাষায় বিস্তৃতভাবে বর্ণনা করেছেন।

সিজার নিহত হবার পর তার পালিত পুত্র অক্টাভিয়ান অগাস্টাস শাসন ক্ষমতায় আসেন এবং নিজের নামের সঙ্গে সিজার নামটি যোগ করেন। সিনেট তাকে প্রিন্সেপ সিনেটাস উপাধি দান করে। তার সময়ে রোমে আবার রাজতন্ত্র বলা ভালো সম্রাটতন্ত্র কায়েম হয়। যদিও সিজার ক্ষমতায় আসার আগের শাসক সুল্লার সময় থেকেই প্রজাতান্ত্রিক ব্যবস্থা নড়বড়ে হয়ে রাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার লক্ষণ প্রকাশ পাচ্ছিল । অবশ্য সিজারের হত্যা থেকে এই সম্রাটতন্ত্র কায়েম হওয়ার জন্য সময় লেগেছিল ১৭ বছর। এই সম্রাটতন্ত্রের সময়কাল 27 BC থেকে 476 AD.


ইতিহাসের পরিহাস :

"অলক্ষ্যে যিনি ইতিহাস রচনা করেন তিনিও কি কিছু কম পাগল?"- লেখক রজত পালের এই কথাটির সঙ্গে দ্বিমত হবার বিশেষ অবকাশ নেই। নইলে রোমের ইতিহাসের ক্ষেত্রে ইতিহাস-দেবতা নামের এমন অদ্ভুত সমাপতন ঘটাবেন কেন ?

প্রথমত, গ্রীস থেকে চলে আসা ইনিয়াসের হাতেই রোমের পূর্ব ইতিহাস সূচিত হয়, বলা চলে। অথচ পরে রোমানরা তাদের সঙ্গে গ্রিসের রক্তের ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ককে গুরুত্ব দিল না, পক্ষান্তরে তারা নিজেদের পূর্ব পিতৃভূমি গ্রীস দখল করল। এর থেকে কি এটাই প্রমাণিত হয় না যে অতীতের সম্পর্কের তুলনায় বর্তমান অবস্থাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ, অতীতকে অন্ধের মত আঁকড়ে ধরে বর্তমানে মানুষ চলতে পারে না? তাহলে অতীতে কোন জাতির সঙ্গে কোন জাতির, কোন ধর্মের সঙ্গে কোন ধর্মের মানুষের সংঘাত হয়েছিল তা নিয়ে বর্তমানে মাথা ফাটাফাটি কেন করে মূর্খরা ?

দ্বিতীয়ত, লুসিয়াস জুনিয়াস ব্রুটাসের নেতৃত্বে একদিন টারকুইনাস সুপারবাসের সঙ্গেই রাজতন্ত্র বিলোপ হয়ে রোমে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। আবার কয়েকশো বছর পরে তার‌ই বংশধর দুই ব্রুটাসের হাতে প্রজাতন্ত্রের কফিনে পেরেক পোঁতা হল। একইভাবে দেখা যাচ্ছে, এক রমুলাসের হাতে রোমের পত্তন, আবার শেষ রোমান সম্রাটের নাম‌ও রোমুলাস। এরপর আর কোন রোমান রোম সাম্রাজ্যের সম্রাট হননি।


Francis Bacon বলেছিলেন, "Histories make men wise". আমার ধারনা হিস্ট্রিজ মেক মেন ইমাজিনেটিভ টু- ইতিহাস মানুষকে কল্পনা প্রবণও করে তোলে ।

আমি ক্রিটিক নই, রসতীর্থপথের পথিক হতে চাই।

এই বইতে ইতিহাসবিদ রজত পাল যে তথ্য- নির্ভর যুক্তি সাজিয়েছেন ও বিশ্লেষণ করেছেন তা পাঠকের ভাবনাকে অবশ্যই সমৃদ্ধ করবে। তথ্য রয়েছে অথচ নির্ভার। অসাধারণ সরল সহজবোধ্য ভাষায় বইটা লেখা হয়েছে। এই বই আমার কল্পনার ডানাকে ওড়বার শক্তি যুগিয়েছে। অনেক ঘটনাকে নিজের কল্পনায় ভর করে সাজানোর চেষ্টা করেছি, ভেবেছি, হয়তো এমন ঘটেছিল, অথবা, যদি এমন হতো। তেমনই কয়েকটি ঘটনা এখানে উল্লেখ করছি, কোন পাঠকের যদি ভালো লাগে তা আমার বড় প্রাপ্তি বলে মনে করব।

প্রথমে তিনটি প্রেম কাহিনী।


রিয়ার কাহিনী : কুমারী রিয়ার সন্তানদের পিতা কে এই নিয়ে দুটি কাহিনী বইটিতে রয়েছে। একটি কাহিনীতে বলা হচ্ছে, রিয়া দেবতা মার্স কর্তৃক ধর্ষিতা হয়েছিলেন। অসম্ভব নয়, দেবতা এবং মুনিঋষিরা ধর্ষণ করার ব্যাপারে বেশ দক্ষ, তা বিদেশের এবং আমাদের পৌরাণিক কাহিনীতেও পাওয়া যায়। আরেকটি কাহিনীতে বলা হয়েছে যে রিয়া টাইবার নদীতে জল আনতে যেতেন। সেখানে নদীর দেবতা টাইবেরিয়াসের সঙ্গে তার প্রেম হয়, যার ফসল রমুলাস ও রেমাস। আমার মনে হয় যে তা যদি সত্যি হতো তাহলে রিয়ার পক্ষে তার গর্ভবতী হওয়ার ঘটনা টাইবেরিযয়াসকে জানানোর অসুবিধা ছিল না। সে ক্ষেত্রে টাইবেরিয়াস রিয়ার দায়িত্ব নিতে পারতেন, রিয়ার ওপর রাজকোপ নেমে আসত না। অবশ্য তাহলে আর রোম সাম্রাজ্য গড়ে উঠতো কিনা সন্দেহ আছে।


দ্বিতীয় কাহিনী, নুমা এবং উপদেবী এগেরিয়ার প্রেম। অপূর্ব রোমান্টিক কাহিনী। এগেরিয়ার সাহায্য এবং বুদ্ধিমত্তা ছাড়া নুমার পক্ষে অত সুন্দরভাবে রাজ্য শাসন করা সম্ভব হতো কিনা যথেষ্ট সন্দেহ। অবশ্য নুমাও অসাধারণ বুদ্ধিমান। বুদ্ধির খেলায় তিনি দেবরাজ জুপিটারকেও বশ করে ফেলেন। কাহিনীটা এইরকম: এক বছর রোমে প্রবল প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছিল। এগেরিয়ার পরামর্শে নুমার পূজায় সন্তুষ্ট হয়ে জুপিটার দেখা দিলেন। জুপিটারকে সন্তুষ্ট করার জন্য নুমা জানতে চাইলেন কি করতে হবে। জুপিটার তাকে মানুষের মাথা দিতে বলেন। নুমা কৌশলে মাথার বদলে মাথার চুল উৎসর্গ করার স্বীকৃতি আদায় করেন। বলতে হবে নুমা তার বুদ্ধির কৌশলে আমিষভক্ত দেবতাকে নিরামিষাসিতে পরিণত করে দিলেন।পুরো কাহিনীটাই এই বইতে বলা আছে।

আচ্ছা, আমাদের দেশে দেবতার কাছে যে মাথার চুল দেওয়ার প্রথা আছে, তার সঙ্গে কি এমনই কোন ঘটনার সম্পর্ক আছে ? শিরের বদলে কেশদান!


তৃতীয়টি বহু চর্চিত, বহু প্রচলিত এন্টনি ও ক্লিওপেট্রার কাহিনী: দুটি চরিত্রই বহুগামী। দুজনেরই নারী বা পুরুষদের সঙ্গে সম্পর্কর পিছনে ব্যক্তিগত স্বার্থ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য রয়েছে। কিন্তু তবুও, এই বইয়ের কাহিনী পড়ে মনে হয় দুজনের মধ্যে একটা প্রেমের সম্পর্ক‌ও ছিল। না হলে অক্টাভিয়ান যখন ক্লিওপেট্রাকে শর্ত দিল যে এন্টনিকে ধরিয়ে দিলে ক্লিওপেট্রার প্রাণ ও রাজ্য নিরাপদ, তখন ক্লিওপেট্রা সেই শর্তে রাজি হলো না কেন? আবার এন্টনি যখন খবর পেল যে ক্লিওপেট্রা আত্মহত্যা করেছে তখন সে-ই বা আত্মহত্যা করল কেন? এই দুটি ঘটনা থেকে মনে হয় যে দুজনেরই রাজনৈতিক ও আত্ম স্বার্থ থাকা সত্ত্বেও তার বাইরে পরস্পরকে তারা সত্যিই ভালোবেসে ফেলেছিল।


এবার অন্য কয়েকটি প্রসঙ্গ।


অগ্নি রক্ষিকা বা ভেস্টাল ভার্জিন: রোমের ইতিহাস শুরু হওয়ার বহু আগে থেকেই সমাজে একটি ধর্মীয় প্রথা প্রচলিত ছিল যাতে কুমারী মহিলারা মন্দিরে অগ্নি সুরক্ষিত রাখার দায়িত্ব পালন করতেন। এই মহিলাদের আমৃত্যু কুমারী থাকতে হতো। এরা হতেন মন্দিরের পূজারিণী, সমাজে তাদের যথেষ্ট সম্মান ও প্রভাব প্রতিপত্তি থাকতো।

মন্দিরে অগ্নি সুরক্ষিত রাখা- এই প্রথা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রচলিত ছিল। আমাদের দেশে এখনো কিছু দেবস্থান আছে , যেখানে নাকি বহু যুগ আগে থেকে অগ্নি প্রজ্জ্বলিত রাখা আছে, কখনো নিভতে দেওয়া হয় না। এই প্রথার পেছনে কারণ কী হতে পারে? কয়েক শতাব্দী আগেও আগুন জ্বালানো খুব সহজ কাজ ছিল না। তাই হয়তো নগরে গ্রামে মন্দিরের মধ্যে অগ্নিকে সুরক্ষিত রাখা হতো, জ্বালিয়ে রাখা হতো নিভতে দেওয়া হতো না, যাতে মানুষ প্রয়োজন মত সেই আগুন থেকে আবার আগুন জ্বালিয়ে নিয়ে ব্যবহার করতে পারে। অগ্নি উপাসনার সম্ভবত এভাবেই সৃষ্টি।


শ্রেণী উল্লম্ফন: প্যাট্রিসিয়ান ও প্লেবিয়ান সম্পর্কে পরিচয় দেওয়ার বিশেষ কিছু নেই। যে তিন গোষ্ঠী রোমের প্রতিষ্ঠা করে তারাই পেট্রিশিয়ান হয়। তারা সমাজের বিশেষ সুবিধাভোগী ছিল। আর অধিকৃত অঞ্চলের মানুষজন এবং যুদ্ধবন্দীরা ছিল প্লেবিয়ান।তাদের প্রথমদিকে অনেক কিছু সামাজিক অধিকার ছিল না। ক্রমাগত আন্দোলনের ফলে তারা সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকার অর্জন করে, এমন কি পেট্রিশিয়ানদের কাজেও হস্তক্ষেপ করার অধিকার অর্জন করে। ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতাহীনদের সামাজিক বৈষম্য কোন আশ্চর্য ব্যাপার নয়। কিন্তু এখানে আশ্চর্য ব্যাপার হচ্ছে যে প্যাট্রিসিয়ান থেকে প্লেবিয়ান হওয়া যেত। যেমন ক্লডিয়াস হয়েছিল । কিন্তু কিভাবে, তার উল্লেখ নেই বইটিতে। এটা বেশ আশ্চর্য লেগেছে। আমাদের দেশেও প্রাচীন কালে কর্ম অনুযায়ী বর্ণান্তর ঘটত। ব্রাহ্মণের‌ও শূদ্রত্ব প্রাপ্তি হতো। তবে তা হতো কর্মের ভিত্তিতে, সমাজ সেই বর্ণান্তর ঘটাতো। কিন্তু রোমে দেখা যাচ্ছে কোন ব্যক্তি স্বেচ্ছায় তার শ্রেণী অবস্থান পরিবর্তন করতে পারত। তাই কি?


একটি সন্দেহ: সুশাসক সার্ভিয়াস যিনি দাসীগর্ভে জন্মেছিলেন, তার পিতা কে? লেখক অনুমান করেছেন রাজা টার্কুইন। কিন্তু এ ব্যাপারে আমার একটা সন্দেহ রয়েছে। কারণ রানি টারনাকুইল নিজের মেয়ে টার্কুইনিয়ার সঙ্গে সার্ভিয়াসের বিবাহ দেন। একই পিতার ছেলে মেয়ের মধ্যে জেনে শুনে তিনি কি বিবাহ দিতেন?


স্পুরিন্না : "আইডস অফ মার্চ", "বাট নট গন"-এর উচ্চারণকারী ভবিষ্যৎবক্তাটি কে? শেক্সপিয়ারের জুলিয়াস সিজার পড়ার সময় তার নাম জানতে বড় কৌতুহল হোত। এমন নিখুঁত ভবিষ্যৎ বক্তা! এ যুগে থাকলে নেতাদের কাছে ভি আই পি হয়ে যেতেন। অথচ সিজার তাকে পাত্তাই দিলেন না। কিন্তু তার ভবিষ্যৎ বাণী অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেল। এই বই পড়ে জানতে পারলাম তার নাম ছিল স্পুরিন্না।


সেকালেও রিগিং?!

ব্যাপারটা জেনে প্রথমে বেশ আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলাম। যখন টাইবেরিয়াস ভূমিসংস্কার বিল এনে অভিজাতদের হাতে থাকা অতিরিক্ত জমি সাধারণ মানুষের মধ্যে বিলি করে দিতে চাইলেন তখন স্বাভাবিকভাবে অভিজাত সম্প্রদায় তার বিরোধিতা করল। সাধারণের প্রবল সমর্থন পেলেন তিনি। কিন্তু ভোটেতে প্রচন্ড রিগিং হওয়ার ফলে তিনি পরাজিত হন।


আবার সিজার, ব্রুটাস ও অক্টাভিয়ান :


সিজারের জীবন ও কর্ম নিয়ে এই বইতে বিস্তৃত আলোচনা করেছেন রজত পাল। তবুও সিজার সম্বন্ধে দু একটি কথা আরো বলা যেতে পারে। মানুষটি অসাধারণ ছিলেন আক্ষরিক অর্থেই। শুধু দক্ষ রাজনীতিক বা রণনিপুণ যোদ্ধাই নন, আরো বহু গুণের অধিকারী ছিলেন সিজার। কুড়ি বছর বয়সের মধ্যেই বিশিষ্ট দক্ষ যোদ্ধা হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করেছিলেন। যখন যুদ্ধ করতে হতো না তখন বিস্ময়জনক উৎসাহ ও শক্তি নিয়ে রোমের শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা এবং অর্থনৈতিক উন্নতিতে নিজেকে নিয়োগ করতেন। ট্যাক্স ব্যবস্থার সংশোধন, আইন বিধিবদ্ধকরনের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন। আজও ইউরোপের বহু দেশে নাকি সিজারকৃত আইন এখনো প্রচলিত, যেমন নেপোলিয়নকৃত আইন প্রচলিত আছে। আবার একটি সাধারন পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিনি অসাধারণ জ্যোতির্বিদ (অ্যাস্ট্রোনমার) এবং গণিতজ্ঞও ছিলেন। গ্রহ নক্ষত্রের বিষয়েও তিনি কিছু কাজ করেছিলেন। তিনি পঞ্জিকার সংস্কার করেন যা জুলিয়ান ক্যালেন্ডার নামে পরিচিত, তার নামের থেকে মাসের নাম জুলাই হয়। (প্রসঙ্গত মনে পড়ল, ফ্রান্সের নেপোলিয়ন বোনাপার্ট এবং ভারতের শেরশাহ বড় গণিতবিদ ছিলেন।) আল্পস পেরিয়ে স্পেন যাওয়ার পথে যেতে যেতে তিনি নাকি একটি গ্রামার বইও লিখেছিলেন। সিজার নাকি বড় প্রতিভাশালী লেখক‌ও ছিলেন। তার লেখা কমেন্টারিজ অন দ্যা গেলিক ওয়ার্স এবং সিভিল ওয়ার বই দুটিকে বিশেষজ্ঞরা নাকি মাস্টারপিসেস অফ ন্যারেটিভ স্কিল বলে অভিহিত করেন। এই বই দুটি ছাড়া তার অন্যান্য রচনা টিকে থাকেনি।


এর পর আসছে ব্রুটাসের কথা। মার্কাস ব্রুটাস। শেক্সপিয়ার তার নাটকে এই চরিত্রকে যে মহান উচ্চতায় নিয়ে গেছেন তা পাঠকের মনে ব্রুটাসকে চিরস্মরণীয় করে রাখে। আদর্শই হল তার চরিত্রের হ্যামারশিয়া বা ট্রাজিক ফ্ল, যে জন্য তাকে শেষ পর্যন্ত মরতে হলো। শেক্সপিয়ারে আমরা দেখি এন্টনি তার সম্বন্ধে বলছেন,

"His life was gentle, and the elements

So mix'd in him, that Nature might stand up

And say to all the world, 'This was a man!' "

জিজ্ঞাসা থেকেই যায় যে সত্যিই কি তিনি শুধু আত্মস্বার্থে সিজার হত্যার চক্রান্তে যোগ দিয়েছিলেন? যে ব্রুটাস রোমবাসীদের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুড়ে দেন,

"Who is so base that would be a bond man?"

তার মনে কি প্রজাতন্ত্র রক্ষা করার আকাঙ্ক্ষা আদৌ ছিল না?

আবার যে এন্টনি সিজারের এত অনুগত, তার সম্পর্কে সিসেরো বলছেন যে সিজারকে হত্যা করার জন্য এন্টনি ঘাতক নিয়োগ করেছিলেন।

তবে ব্রুটাসের ভূমিকায় যে সিজার তার অন্তিম মুহূর্তে ভয়ংকর তীব্র মানসিক আঘাত পেয়েছিলেন তা ঐতিহাসিক সত্য। শেক্সপিয়ার মাত্র ছয়টি শব্দে সিজারের সেই মনোভাব ব্যাখ্যাতীর ভাষায় ফুটিয়ে তুলেছেন,

"Et tu Brute ! Then fall Caeser".

ইতিহাস বলছে, আক্রান্ত হয়ে সিজার এদিক ওদিক দৌড়ে বেড়াচ্ছিলেন আত্মরক্ষার জন্য, কিন্তু যখন তিনি ব্রুটাসকে তরোয়াল হাতে এগিয়ে আসতে দেখেন, তখন তিনি নিজের পোশাক দিয়েই নিজের মুখ ও মাথা ঢেকে ফেলেন এবং পড়ে যান।


এবার অকটাভিয়ান সিজার।

অক্টাভিয়ান সিজার সম্পর্কে লেখক রজত পালকে একটু পক্ষপাতপূর্ণ মনে হয়েছে। তিনি অক্টাভিয়ানের সুকর্ম ও দুষ্কর্ম উভয়েরই উল্লেখ করেছেন, তবে তার সুকর্মের যেমন প্রশংসা করেছেন, দুষ্কর্মের সমালোচনা তেমন করেননি।

আমার চোখে এই অক্টাভিয়ান অসম্ভব ধূর্ত, প্রবল উচ্চাকাঙ্ক্ষী। ক্ষমতা লাভের জন্য করতে পারে না এমন কোন কাজ নেই। তার রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও ক্ষমতার লোভ এত বেশি যে হয়তো সে তর পালক পিতা সিজারকেও হত্যা করতে দ্বিধা করত না। রাজনৈতিক স্বার্থ পূরণের জন্য ক্লডিয়াকে ডিভোর্স দিয়ে সেক্সটাসের শ্যালিকাকে বিবাহ করে। সিজার ও ক্লিওপেট্রার পুত্র সিজারিয়ানকে হত্যা করে, এন্টনির পুত্র অ্যান্টিলাসকেও হত্যা করে, পাছে তারা ভবিষ্যতে তার ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বী হয়। সহায় সম্বলহীন সিজার পুত্রকে হত্যা করা সিজারের প্রতি তার আনুগত্যের পরিচায়ক নয় মোটেই। এছাড়া ফালভিয়া ও ক্লিওপেট্রার হত্যার পেছনে তার হাত থাকার যথেষ্ট সম্ভাবনার কথা লেখক জানিয়েছেন। যে লেপিডাসের সাহায্যে তিনি বহু উপকৃত, সেই লেপিডাসকে তিনি সমস্ত ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিয়েছেন। শুধু রণকৌশল, কুটকৌশল ও রাজনৈতিক বিচক্ষণতার পরিচয় পাওয়া যায় অক্টোভিয়ানের চরিত্রে।

Title সিজার এবং রোমের কথা ও কাহিনী
Author
Publisher
ISBN 9789394659261
Edition Edition, 2024
Number of Pages 252
Country ভারত
Language বাংলা

Sponsored Products Related To This Item

Reviews and Ratings

sort icon

Product Q/A

Have a question regarding the product? Ask Us

Show more Question(s)

Customers Also Bought

loading

Similar Category Best Selling Books

prize book-reading point
Superstore
Up To 65% Off

Recently Viewed

cash

Cash on delivery

Pay cash at your doorstep

service

Delivery

All over Bangladesh

return

Happy return

7 days return facility

Video

0 Item(s)

Subtotal:

Customers Also Bought

Are you sure to remove this from bookshelf?

Write a Review

সিজার এবং রোমের কথা ও কাহিনী

রজত পাল

৳ 800 ৳800.0

Please rate this product