মোদ্দা কথা, কবিতা হচ্ছে শব্দ প্রয়োগের ছান্দসিক কিংবা অনিবার্য ভাবার্থের বাক্য বিন্যাস; যা একজন কবির আবেগ-অনুভূতি, উপলব্ধি ও চিন্তা করার সংক্ষিপ্ত রূপ এবং তা অত্যাবশ্যকীয়ভাবে উপমা-উৎপ্রেক্ষা-চিত্রকল্পের সাহায্যে আন্দোলিত করে। এই ‘আন্দোলন’ চৈতন্যে সংসিদ্ধ পাঠকদের হৃদয়তলে সার্থকভাবে তখুনি স্ফুরণ তোলে কবিতা যখন সংবেদনশীল শব্দাশ্রয়ের মাধ্যমে গভীর সঙ্কেত তৈরি করে। কবির নিজস্ব উদ্ভাবিত কিংবা আহরিত শব্দমালা কবিতার দেহভাষা শুধু নির্মাণ করে না, বর্ণিল আত্মাও। দশাবিপর্যয়েও যে আত্মার বিচ্যুতি ঘটে না বরং নির্ব্যুঢ় ঘোর প্রতিস্থাপন করে পাঠকদের ইন্দ্রিয়সমূহে। শব্দই কবিতার বিশুদ্ধ ক্লোরোফিল। কোলরিজের ভাষায়, best word in the best order. কখনও কখনও বহুমাত্রিক দ্যোতনার ওজোভারে বলিষ্ঠ একটিমাত্র শব্দের জন্যেও কবিকে চণ্ডীদাসের মতো ছিপ ফেলে অপেক্ষা করতে হয়।
জিল্লুর রহমান শুভ্র কর্তৃক ইংরেজিতে রচিত দুটো কবিতার বই Love and Fallen Leaves ও Bible of Love and Obscurity প্রকাশিত হয়েছে লন্ডন থেকে। বাংলায় এই প্রথম কবিতার বই প্রকাশিত হচ্ছে তার। আত্মশ্লাঘায় নির্মোহ এই কবি বিশ্বসাহিত্য থেকে কবিতার রূপ-রস-গন্ধ আত্মস্থ করার যৎকিঞ্চিৎ চেষ্টা করেন; বিধায় এই বইয়ে অন্তর্ভুক্ত কবিতাগুলো পাঠ করলে বোঝা যায় গতানুগতিক ধারার পক্ষপাতদুষ্ট কবিতা তিনি লেখেন না। ইতিহাস, পুরাণ ও প্রপঞ্চময় শব্দের মেলবন্ধন ঘটিয়ে এমন এক অক্সিটসিন তৈরি করেন--যা ইয়েটস ও জীবনানন্দীয় ভাবধারাকে প্রবাহিত করে মন ও মননের গভীরে। তার কবিতা জটিল, দুর্বোধ্য, আবার সহজও; তবে সহজ কবিতাকে তিনি দুর্বল কবিতা মনে করেন। এ সম্পর্কে তারই রচিত কবিতার দুটো লাইন বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য: ‘যারা প্রহেলিকার কৌপীন পরে খোঁড়ে না অন্ধকার;/তারা না কবি না কবুতর।’ বিশ্বব্যাপী হানাহানি, অর্বাচীন উন্মাদনা, মারি ও মড়কের এই অস্থির, ক্লেদাক্ত ও চণ্ডাল সময়ে তার ‘ঝাউপাতার ঝাঁপতাল’ হতে পারে ব্রহ্মকমল ফুলের ঘ্রাণ।
জিল্লুর রহমান শুভ্র, জন্ম ১২ অক্টোবর, ১৯৬৪ ইং; নওগাঁ জেলার ধামইর হাট থানার ইশবপুর ইউনিয়নের অন্তর্গত রাংগাল ঘাট গ্রামে। আজন্ম দরিদ্রতা তার মাথার উপর খড়গ হয়ে অবলীলায় শাসন করেছে। তদুপরি শৈশবে স্বচক্ষে দেখেন ১৯৭১-এর দানবীয় নৃশংসতা। এই নৃশংসতার মধ্যেই বাবাকে হারিয়ে বিপর্যয়ের চূড়ান্ত সুখ অনুভব করেন তিনি। কিন্তু জীবন থেমে থাকেনি। বিভিন্ন অভিঘাতের সংবেদনশীল ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মধ্য দিয়ে অতিক্রম করেছেন জীবনের জটিল পথ।
স্কুলজীবনে ছিলেন অসম্ভব মেধাবী ছাত্র, কলেজে গিয়ে জড়িয়ে পড়েন বাউণ্ডুলেপণায়; ফলে লেখাপড়ার গতি হয় ব্যাহত। কলেজবন্ধুরা তাকে হিরো-হিরো বলে ক্ষেপাত। হিরো হওয়ার উদগ্র বাসনা তাকে তাড়া করে বুনো ষাঁড়ের মতো। ফলে উচ্চাভিলাষী ষড়যন্ত্রের ফাঁদে পা দেন তিনি। পালিয়ে আসেন ঢাকায়। বিপরীত জীবনের নোনতা স্বাদ গ্রহণে বাধ্য হন তিনি। বদল করেন একের পর এক পেশা। জড়িয়ে পড়েন বিভিন্ন অপরাধ কর্মে। পূর্ণ করেন পাপের ষোলকলা; তবে কোথাও থিতু হননি তিনি। দৌড়ের উপর থেকেও লিখে গেছেন দিস্তার পর দিস্তা। সেসব লেখা ছাইভস্ম হলেও লেখার বীজ তার সৃজনশীল মনোভূমিতে মুকুলিত হয়েছে তখন থেকেই।
অ্যাগোরাফোবিয়া ও আত্মশ্লাঘায় নির্মোহ এই লেখক আজ অব্দি লিখে যাচ্ছেন অবিরাম। বাংলা ও ইংরেজি দু ভাষাতেই লিখেছেন। The God of Love & Fallen Leaves, The Dark Moon, A Creative Killer, Bible of Love & Obscurity লন্ডনের Olympia Publishers থেকে প্রকাশিত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ঢাউস উপন্যাস ’চন্দ্রদাহ’ ও কবিতার বই ’ঝাউপাতার ঝাঁপতাল’ প্রকাশিত হয়েছে পুণ্ড্র প্রকাশন থেকে। অনুপ্রাণন প্রকাশন থকে প্রকাশিত হয়েছে গল্পগ্রন্থ ঘোড়ামুখী (মে-২০২৫)