রবীন্দ্রপ্রতিভার দীপ্তি বাংলার সমাজ ও সভ্যতাকে দারুণভাবে আলোকিত করে তোলে। তিনি বিচিত্র আঙ্গিকের সাহিত্যকর্মে আত্মনিয়ােগ করেছিলেন। তার কবিজীবন ছিল দীর্ঘ ও বহু সৃষ্টিসম্ভারে পূর্ণ। মানসী-সোনারতরী কাব্য থেকে তার বিকাশ পর্ব শুরু হয়। পরবর্তীকালে কল্পনার জীবন থেকে নৈবেদ্যর জীবনের মধ্যে একটি স্বাভাবিক পরিণতি লক্ষণীয়। বস্তুত যে গভীর ও গম্ভীর জীবনের আকুতি কল্পনায় প্রতিভাত তার পরিণতি নৈবেদ্য থেকেই শুরু হয়। কিন্তু এই স্বাভাবিক বিবর্তন পর্যায়ে একটি অপরূপ কাব্যগ্রন্থ মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে রচিত হয় : সে কাব্য ক্ষণিকা। এর নামকরণের মধ্যে কাব্যের বৈশিষ্ট্য প্রতিফলিত। এক জীবন থেকে অন্য জীবনে রূপান্তরের মধ্যবর্তী কয়েক মাসের জন্যই ক্ষণিকার উদয় ও অন্ত। ১৩০০ বঙ্গাব্দের শ্রাবণ মাসে প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ক্ষণিকা কাব্যে আমরা কবি-ভাবনা ও প্রকাশরীতিতে পরিবর্তন লক্ষ করি। চৈতালি-কাল থেকে দীর্ঘদিন রবীন্দ্রনাথের মন্ময় ভাব ও বিষন্নতার জগতে কেটেছে। কণিকা, কল্পনা, কথা, কাহিনী পেরিয়ে ক্ষণিকায় এসে কবি পুরাতন গভীর ভাবনা ও গাম্ভীর্য থেকে মুক্ত হয়ে অনেকটা নির্ভার ও চটুল হয়ে উঠেছেন। এই কাব্য বিশ্বাত্মবােধের কোনো গভীর তত্ত্ব বা সৌন্দর্যধ্যান-রহস্যের ভাষ্য নয়, এতে পাই যাবতীয় দ্বৈরত্ব অতীত এক নির্মল ও স্বচ্ছন্দ কবি-স্বভাবের পরিচয়। কবি হিসেবে যে রবীন্দ্রনাথ লঘু কল্পনাকেও পরিত্যাগ করেন না এখানে তা বােঝা যায়। তিনি সংস্কৃত কাব্যের প্রভাবও এখানে প্রকাশ করেছেন। তিনি আধুনিক কবি হিসেবে সংস্কৃত সাহিত্যের রসপ্রীতিটি আত্মস্থ করে এই কাব্যের একাধিক কবিতায় তা রূপায়িত করেন। আলোস পর্ব থেকে কবি-চেতনার যে নতুন রূপ তা প্রকাশ পেয়েছে ক্ষণিকা কাব্যের ‘উদ্বোধন' কবিতায়। এখানে কবি বলেছেন দুশ্চিন্তা, দুর্ভাবনা, সমস্যা। এসব থাকবেই; তবু তিনি জীবনের আনন্দকে প্রাণভরে উপভোগ করতে চান?
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন একাধারে ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, ছোটগল্পকার, চিত্রশিল্পী, সংগীতস্রষ্টা, অভিনেতা, কন্ঠশিল্পী, কবি, সমাজ-সংস্কারক এবং দার্শনিক। গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদের জন্য প্রথম বাঙালি হিসেবে ১৯১৩ সালে তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরষ্কার লাভ করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৬১ সালের ৭ মে তৎকালীন ব্রিটিশ-শাসিত ভারতে কলকাতার ধনাঢ্য ও সংস্কৃতিমনা জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশব থেকেই তিনি লেখালেখিতে মনোনিবেশ করেন। ভানুসিংহ ঠাকুর ছিল তাঁর ছদ্মনাম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর বই মানেই এক মোহের মাঝে আটকে যাওয়া, যে মোহ পাঠককে জীবনের নানা রঙের সাথে পরিচিত করিয়ে দেয় নানা ঢঙে, নানা ছন্দে, নানা সুর ও বর্ণে। তাঁর ৫২টি কাব্যগ্রন্থ, ৩৮টি নাট্যগ্রন্থ, ১৩টি উপন্যাস, ৩৬টি প্রবন্ধ ও অন্যান্য গদ্যসংকলন জীবদ্দশায় বা মৃত্যুর কিছুদিন পরই আলোর মুখ দেখে। কাবুলিওয়ালা, হৈমন্তী, পোস্টমাস্টারসহ মোট ৯৫টি গল্প স্থান পেয়েছে তাঁর ‘গল্পগুচ্ছ’ গ্রন্থে। অন্যদিকে ‘গীতবিতান’ গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে ১,৯১৫টি গান। উপন্যাস, কবিতা, সঙ্গীত, ছোটগল্প, গীতিনাট্য, প্রবন্ধ, ভ্রমণকাহিনীসহ সাহিত্যের সকল শাখাই যেন ধারণ করে আছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর বই সমূহ। তিনি একাধারে নাট্যকার ও নাট্যাভিনেতা দুই-ই ছিলেন। কোনো প্রথাগত শিক্ষা ছাড়া তিনি চিত্রাংকনও করতেন। তৎকালীন সমাজ-সংস্কারেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন এই গুণী ব্যক্তিত্ব। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষাতেই অনূদিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর বই সমগ্র। তাঁর যাবতীয় রচনা ‘রবীন্দ্র রচনাবলী’ নামে ত্রিশ খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৪১ সালের ৭ আগস্ট জোড়াসাঁকোর বাড়িতেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুর পর এতদিন পেরিয়ে গেলেও তাঁর সাহিত্যকর্ম আজও স্বমহিমায় ভাস্বর। আজও আমাদের বাঙালি জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে বিশ্বকবির সাহিত্যকর্ম।