কবিতাই বাংলা সহিত্যের প্রধানতম ধারা। এজন্যে বাংলা ভাষায় কবির সংখ্যা এতো বেশি। বাংলা কবিতার বাঁকবদলে সবসময় তরুণ কবিরা অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে। কবিতার পরিকাঠামো, বিষয়বস্তু, উপমা উৎপ্রেক্ষার ব্যবহার ক্রমাগত বদলেছে। এই বদলের সম্মুখ সারিতে মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাশ এবং জসীমউদদীন মুখ্য ভূমিকা রেখেছে। এসব কবিরা তারুণ্যেই তাদের প্রতিভার শিল্পসম্মত সপ্রকাশ ঘটিয়েছে। বাংলা সাহিত্যে নারীদের চেয়ে পুরুষের প্রধান্য। এজন্যে জন্মেছেন কামিনী রায়, কুসুম কুমারী দাশ, বেগম সুফিয়া কামাল, খালেদা এদিব চৌধুরী, কাজী রোজী, সারাইয়া খানম, নাসিমা সুলতানা, শামীম আজাদ, সুহিতা সালতানা, জাহানারা পারভীন প্রমুখরা। নারী ও পুরুষের সহজিয়া অনুপ্রবেশ বাংলা কবিতার প্রতিবেশকে অনেক প্রাণদায়ী রেখায় রুপান্তরিত করেছে। কিন্তু বাংলা কবিতার প্রচল ধারা ভেঙে মুষ্টিমেয় যে কবিরা স্মরণীয় তাদের মধ্যে মাইকেল, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ দাশই অগ্রগণ্য।
পঞ্চাশ, ষাট, সত্তুর ও আশির দশকের কবিরা প্রচল ধারাকে ভাঙতে নানা ফর্ম ও বিষয়ের অবতারণা করেছে। কিন্তু পূর্ববর্তীদের জায়গা কেউ টলাতে পারেনি। তবে ষাটের আবদুল মান্নান সৈয়দ, রফিক আজাদ এবং পশ্চিমবঙ্গের শক্তি চট্টোপধ্যায় ও বিনয় মজুমদার কর্ম এবং বিষয়কে অনেকখানি এগিয়ে নিয়েছেন। বাংলা কবিতার জালধারা লোকমানুষের ধারক অপ্রতিষ্ঠানিক এবং অন্যটি প্রতিষ্ঠানিক বা প্রচল ধারা। এর মধ্যে নানা মতবাদের অনুপ্রবেশ আছে। ডাডাইজম, সুরবিয়লিজম, ম্যাজিক বিয়ালিজম, পায়েন্টালিজম এসব ধারায় অনেকে কবিতা লিখে প্রতিষ্ঠা নিতে চেয়েছে। কিন্তু লক্ষণীয় যে কবিতা সহজ, প্রাঞ্জলও বোধগম সেটিই পাঠক নিয়েছে।
শূন্য দশকের কবিরা নিজেদের আলাদা করতে নতুন বাক্যবিন্যাসের আশ্রয় নিয়েছে। প্রতীক ও উপমার নবতর অন্বেষণ। প্রতিবছর এদেশের মেলায় নতুন অনেক কবিতার বই প্রকাশিত হয় এবং তরুণরাই বেশি বই প্রকাশ করে থাকে। আমি অনেকের কবিতা নিয়ে আমার্য অভিব্যাক্তি প্রকাশ করি। এবার হাতে এলো খলিফা পলাশের পাণ্ডুলিপি। তিনি কাব্যগ্রন্থের নাম দিয়েছেন ‘জান্নাত’। এটি তার প্রিয়দর্শী নারীর নাম। যেমন- সুনীলের নীরা, আল মাহমুদের আয়েশা আক্তার, জীবনানন্দের বনলতা সেন ইত্যাদি। এই গ্রন্থে মোট ৫৪টি কবিতা আছে। ‘প্রিয়দশির্ণী জান্নাত’ শিরোনামের কবিতার কয়েকটি লাইন উদ্ধৃতি করিÑ
কী নামে ডাকি তাঁরে?
সম্রাট অশোকের ‘বিদিশা’ নয়তো গ্রিক ট্রাজেডি স্পার্টার
রাজা মেনেলাউসের রূপবতী হেলেন।
মহাগুরু লিওনার্দোর মোনালিসা
জীবনানন্দের বনলতা কিংবা সুরঞ্জনা
এভাবেই কালে কালে শিল্পী ও কবিরা তার প্রিয়তমাকে প্রতিষ্ঠা দিয়েছেন মহাকালের ক্যানভাসে।
খলিফা পলাশের জান্নাত গ্রন্থে প্রেম যেমন আছেÑ আছে সামাজিক বৈষম্য সঙ্কটের চিত্র। জীন ও জগতের নানা অভিঘাত। তার এই কাব্যগ্রন্থে পুরাণ থেকে উদাহরণ যেমন আছে, আছে ইতিহাস মিশ্রিত ঘটনা প্রবাহের দোলাচল। একজন তরুণ কবি হিসেবে তার পাঠাকাক্সক্ষা আমাকে মুগ্ধ করেছে।
খলিফা পশাশের জান্নাত গ্রন্থের বহুল প্রচার কামনা করি। তিনি নিজে একজন চিত্রশিল্পী সুদৃশ্য প্রচ্ছদ নিজেই এঁকেছেন।
রেজাউদ্দিন স্টালিন