আরবিসাহিত্যে একমাত্র নোবেল বিজয়ী মিশরের কথাসাহিত্যিক নাগিব মাহফুজের প্রধান সাহিত্যকর্ম 'কায়রো ট্রিলজি'। 'কায়রো ট্রিলজি'-তে কায়রোর একটি পিতৃতান্ত্রিক পরিবারের মধ্যবিত্ত নৈতিকতা ও সাংস্কৃতিক চেতনাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। একটি মিশরীয় পরিবারকে উপন্যাসের কেন্দ্রে রেখে পরিবারটির তিন প্রজন্মের উত্থান পতনের খুঁটিনাটি বিবরণ আধুনিক আরবিসাহিত্যে একটি নতুন ধারার সৃষ্টি করেছে। কায়রো ট্রিলজিতে পারিবারিক কাহিনির পাশাপাশি জাতীয় সামাজিক অবস্থার প্রতিচ্ছবিও অঙ্কিত হয়েছে।
'কায়রো ট্রিলজি' নাগিব মাহফুজকে বিশ্বখ্যাতি এনে দেয় এবং তিনি নোবেল পুরস্কার অর্জনের গৌরব অর্জন করেন। বিশাল এ উপন্যাসটির একই কাহিনিকে তিন ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। 'বায়ান আল-কাসরায়েন' (প্যালেস ওয়াক), 'কসর আল শউক' (প্যালেস অফ ডিজায়ার) ও 'আল-সুক্কারিয়া' (সুগার স্ট্রিট)। গ্রন্থটির জটিল বর্ণনারীতিতে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে যে কীভাবে পিতৃতান্ত্রিক ক্ষমতা সন্তানদের ভাগ্য নির্ধারণ করে, যেখানে ব্যাখ্যাতীত মূল চরিত্র দৃশ্যপটের বাইরে এবং নিজেকে যে বাড়িতে গুটিয়ে নিয়েছেন তা শুধু দূর থেকে দেখা যায়। নাগিব মাহফুজ তাঁর উপন্যাসে এক অর্থে সৃষ্টির সূচনা থেকে ১৯৫০ এর দশক পর্যন্ত মানুষের ইতিহাস তুলে ধরেছেন। একই সাথে এটি কায়রোর শহরতলির শিশুরা যে কী যাতনার মধ্যে কাল কাটায় তাও উঠে এসেছে।
এ উপন্যাসে কায়রোর শহুরে জীবনের বিবরণ সবিস্তারে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। মিশরের পুরনো শাসকগোষ্ঠীর চূড়ান্ত পতন এবং গ্রন্থটির রচনার পরিসমাপ্তির একটি সম্পর্ক রয়েছে। ট্রিলজি নাগিবের নিজস্ব দিক নির্দেশনার অনুসন্ধান এবং ব্যক্তিগত চেতনা ও ইতিহাস তুলে ধরার প্রচেষ্টার প্রতিফলন। এটি আধুনিক মিশরের রাজনৈতিক ও সামাজিক রূপান্তরের বর্ণনামূলক রেকর্ড, যেখানে জাতীয় পরিচিতি এবং আধুনিক বিশ্বে মিশরের অবস্থান খোঁজা হয়েছে। এছাড়া এতে সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের দৃশ্য সুনিপুণভাবে অঙ্কন করার পাশাপাশি মানুষের সম্পর্কের সকল দিক উঠিয়ে আনার চেষ্টাও লক্ষণীয়। সামাজিক ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক নৃতত্ত্বের মূল্যবান দলিল ছাড়াও 'দ্য কায়রো ট্রিলজি'র সাহিত্যমান অনন্যসাধারণ।
(আরবি: نجيب محفوظ) (জন্ম: ডিসেম্বর ১১, ১৯১১ - মৃত্যু: আগস্ট ৩০, ২০০৬) নোবেল বিজয়ী মিশরীয় সাহিত্যিক। নাগিব মাহফুজ মধ্যবিত্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। মাত্র সাত বছর বয়সে তিনি মিশরীয় বিপ্লবে ১৯১৯ অংশ গ্রহণ করেন। তার মাধ্যমিক পরীক্ষার পরে, তিনি দর্শন বিভাগে ১৯৩০ সালে ভর্তি হন মিশরীয় বিশ্ববিদ্যালয় (বর্তমানে কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়)। ১৯৩৪সালে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন জরেন। এর পর ১৯৩৬ সালে দর্শনের গবেষণা কাজে একটি বছর অতিবাহিত করেন। পরে তিনি গবেষনা পরিত্যাগ করেন এবং একটি পেশাদার লেখক হয়ে যান। মাহফুজ তারপর আল-রিসালায়ের জন্য একজন সাংবাদিক হিসেবে কাজ করেন, এবং এল-হিলাল এবং আল-আহরাম ছোটোগল্প লিখতে অবদান রাখেন। নাগিব মাহফুজ ১৭ বছর বয়স থেকে লেখালেখি শুরু করেন। ১৯৩৯ সালে তার প্রথম উপন্যাস প্রকাশিত হয়। জীবদ্দশায় ৩০টি উপন্যাস লিখেলও ১৯৫৫ থেকে ১৯৫৭ সালের মধ্যে প্রকাশিত কায়েরা ট্রিলজি তাঁকে আরব সাহিত্যের এক অনন্য উচ্চতায় তুলে ধরেন। এতে তিনি ইংরেজ শাসন থেকেমুক্ত হওয়ার সময়কালে মিশরের ঐতিহ্যবাহী শহুরে জীবনধারা ফুটিয়ে তোলেন । এ উপন্যাসের স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি ১৯৮৮ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান। নাগিব মাহফুজের উপন্যাসের প্রায় অর্ধেকেরও বেশীর চলচ্চিত্রায়ন হয়েছে। উপন্যাসের পাশাপাশি তিনি ১০০ টিরও বেশি ছোটগল্প রচনা করেছেন। এগুলির বেশীর ভাগই পরে ইংরেজিতে অনুদিত হয়েছে।