খ্যাতনামা ব্রিটিশ লেখক গিবনের বই পড়ার বিষয়ে একটি বিখ্যাত উক্তি আছে। তিনি বলেছেন, ‘কিছু কিছু বই গিলতে হয়, অর্থাৎ পড়েই ভুলে যাওয়া ভালো, কিছু বই একবার পড়াই যথেষ্ট। আবার কিছু বই বার বার করে পড়া দরকার।’ ‘কালের মন্দিরা’ এমনিধরনের একটি বই যা বার বার পড়তে হবে। মন্দিরা হচ্ছে কাঁসার তৈরি করতালজাতীয় একটি বাদ্যযন্ত্রের নাম। লেখক এখানে সময়কে ধারণ করেছেন কালের মন্দিরা বলে। অর্থাৎ মন্দিরার তালের সাথে সাথে সময় যেন কালের দিকচক্রবালে বর্তমানেও বেজে উঠছে।
সত্তর দশকের মাঝামাঝি লেখকের জার্মানিতে থিতু হওয়ার প্রেক্ষিত থেকে নব্বই দশকের মধ্যভাগ পর্যন্ত সেখানে তাঁর যে জীবনালেখ্য তারই ক্রমবিবর্তনের নির্মোহ চিত্র ফুটে উঠছে প্রতিটি পরিচ্ছদে। এই বইর কাহিনিতে বিচিত্র সব চরিত্রের সমাবেশ ঘটেছে। প্রতিটি চরিত্রই যেন একেকটি এপিক বা মহাকাব্য। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে বাংলাদেশের অনেকেই ভাগ্যান্বেষণে ইউরোপে পাড়ি জমিয়েছিলেন। কূটনৈতিক দূতিয়ালির কল্যাণে আশির দশকে জার্মানিতে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বাংলাদেশির আগমন ঘটে। প্রথমে তারা ভ্রমণ ভিসায় আসলেও পরে স্থায়ী হওয়ার জন্য নানারকম কূটকৌশলের আশ্রয় নিয়েছে। এসব কৌশল যতটা না চিত্তাকর্ষক তারচেয়ে বেশি ছিল করুণ আখ্যানে ভরা। কেউ কেউ অনুমতি পেয়েছে আবার কেউ পায়নি। লেখকও অন্য এক কারণে এ সময়ে জার্মানিতে থিতু হন। তিনি খুব কাছে থেকে দেখেছেন স্থায়ী হওয়ার এই মহাকাব্যিক নাটকের কুশীলবদের। এই চরিত্রগুলোর নানারকম বৈচিত্র্য এবং মানবজমিনের এক অদ্ভুত বিশেষত্ব ধরা পড়বে প্রতিটি কাহিনিতে। সেসময় এই মঞ্চে শুধু যে বাংলাদেশী ছিল তা নয়; ভারত ও পাকিস্তান ছাড়াও এশিয়া আফ্রিকা আর লাটিন আমেরিকার ভাগ্যান্বেষী-শরণার্থী এবং স্বল্পসংখ্যক রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থী ইউরোপ তথা জার্মানিতে এসে জড়ো হয়েছে দলে দলে। এদের বিদ্যাশিক্ষা যাই থাকুক না কেন, যে কোনো ধরনের কাজ নিয়ে এরা প্রবাসজীবনের অনিশ্চিত যাত্রা শুরু করে। অনেকেই স্থায়ী হওয়ার ইঁদুর দৌড়ে ছিল চলমান। এই হতভাগ্য মানুষগুলোর ফেলে আসা জীবন করুণ কাহিনিতে আকীর্ণ। লেখক এসব আখ্যানের বর্ণনা পরতে পরতে ফুটিয়ে তুলেছেন স্বভাবসুলভ কথনের মুন্সিয়ানায়। যে কোনো পাঠককে আপ্লুত করবে এসব গল্প।
বইতে আছে মৃত্যু নিয়ে বাণিজ্য করার কয়েকটি করুণ অধ্যায়। মৃত্যুর বহু বিস্ময়, অনেক প্রহেলিকা ও রহস্য রয়েছে। অধিকাংশেরই এখনও কোনো সমাধান হয়নি। মৃত্যুর অজানা ধাঁধাঁর সমাধান কোনোদিনও হবে বলে মনে হয় না। অথচ এই রহস্যময় বিষয়টিকে নিয়ে ইউরোপে চলে অমানবিক বাণিজ্য। এ নিয়ে আছে কয়েকটি অজানা কাহিনি। এসব জানতে হলে ‘কালের মন্দিরা’ পড়তেই হবে।
বোহেমিয়ান লেখক Abdullah Al Haroon প্রায় চার দশক ইউরোপ প্রবাসী। বর্তমানে জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্টের নিকটবর্তী নয়ে-ইজেনবর্গ শহরে থাকেন। জন্ম ১৯৪৫ সালে, রাজশাহীতে। বেড়ে উঠেছেন জামালপুরে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যের পাঠ শেষ করে '৬৮ সালে। পাবনার একটি কলেজে শিক্ষকতা দিয়ে পেশাজীবন শুরু। '৭৭ সাল অবধি কখনও আমলা, কখনও বিদেশি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তা। '৭৭ সালের অক্টোবরে দেশত্যাগ, প্রথমে গ্রিস, তারপর জার্মানি। জার্মানিতে রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থনা মঞ্জুর '৮৫ সালে। '৯৩ সালে পান জার্মানির নাগরিকত্ব। প্রবাসজীবন নানা বৈচিত্র্যে ভরা। আছে দীর্ঘ বেকারত্ব, হোটেলে বাসন-কোসন ধোয়া, কাপড়ের মিলে শ্রমিক, এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট অফিসের কেরানি, হোটেলের নাইট অডিটর, প্যাকার, স্টোরকিপার, সুপারভাইজারসহ নানা রকমের পেশার অভিজ্ঞতা। ২০০২ সালের ডিসেম্বরে চলে যান সুইজারল্যান্ড। সেখানে তিনি অ্যাঙ্গেলবার্গের একটি হোটেলে এবং পরে দাভোজের আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সাত তারা হোটেল গ্র্যান্ড স্টাইগেনবার্গার বেলভেদরে চাকরি নেন। সেখানে তিনি বিল ক্লিন্টন, নেলসন ম্যান্ডেলা, কফি আনান, পিটার উস্তিনভ, পল ম্যাকার্টনি, ম্যাডোনা, রোমান পোলানস্কি, বিল গেটস, টনি ব্লেয়ার, প্রিন্স চার্লস প্রমুখ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খ্যাতিমান ব্যক্তিদের সান্নিধ্যে আসার সুযোগ পান। জার্মানিতে ফিরে আসেন ২০০৫ সালে। বিচিত্র ও চমকপ্রদ এসব অভিজ্ঞতা তাঁর লেখার অনুপ্রেরণা। মৃত্যুপথযাত্রীদের শেষ সময়ে সঙ্গ দেয়ার ইউরোপিয়ান সংগঠন হজপিসের সক্রিয় সদস্য তিনি। সুযোগ পেলেই সানন্দে মৃত্যুসঙ্গ দেন। মৃত্যুসঙ্গ ও মৃত্যু নিয়ে লিখেছেন- জীবনমরণের সীমানা ছাড়ায়ে, অঙ্গবিহীন আলিঙ্গন, মৃত্যু: একটি দার্শনিক জিজ্ঞাসা এবং মত্যসঙ্গীর দিনলিপি এ চারটি বই। ২০০৮ সালের একুশে বইমেলায় প্রথম বই প্রবাসে দৈবের বশের প্রকাশ উপলক্ষে দেশে এসেছিলেন দেশত্যাগের ত্রিশ বছর পর। ২০১০ সালের নভেম্বরে অবসর জীবনের শুরু। সময় পেলে অনুবাদ কাজও করে থাকেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য অনুবাদ কাজের মধ্যে রয়েছে- সুইডিশ উপন্যাস সিটি অব মাই ড্রিমস [ইংরেজি থেকে বাংলা], হার্টা ম্যলারের উপন্যাস- আটেমসাউকেল [জার্মান থেকে বাংলা], টনি ব্লেয়ারের দি জানি, জন পার্কিনসনের– দি কনফেসনস অব এন ইকোনোমিক হিটম্যান [ইংরেজি থেকে বাংলা] ইত্যাদি। রবীন্দ্রসংগীতের বিশেষ অনুরাগী। চার ভাইবোনের মধ্যে তিনি তৃতীয়, বড় ভাই বাংলাদেশের বিশিষ্ট নাট্যজন আবদুল্লাহ আল-মামুন।