ঘরে ফেরার গান : প্রবাসজীবনের নির্মমবাস্তবতা ও করোনাকালের দোলাচল
কামরুল হাসান জনির লেখা ‘ঘরে ফেরার গান’ এক ব্যতিক্রমী উপন্যাস, যেখানে প্রবাসজীবনের আনন্দ-বেদনা, টানাপোড়েন এবং করোনাকালের অভূতপূর্ব সংকট চিত্রিত হয়েছে গভীর সংবেদনশীলতায়। একদিকে যেমন স্বপ্ন পূরণের তাড়না, অন্যদিকে প্রবাসজীবনের নিঃসঙ্গতা—এই দুইয়ের টানাপোড়েন লেখক নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন।
প্রারম্ভিক কথায় লেখক আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন করোনার শিক্ষা—মানুষের অহংকার ও বিভেদের দেয়াল কীভাবে এই অতিক্ষুদ্র জীবাণুর কাছে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়েছে। ধর্ম, বর্ণ, জাতি, শ্রেণি—সব ভেদাভেদ ছাপিয়ে করোনা বুঝিয়ে দিয়েছে, শেষ পর্যন্ত আমরা সবাই এক, একটাই জাতি—মানবজাতি।
প্রবাসজীবনের বিষাদময়তাওঅদেখাযন্ত্রণা : উপন্যাসের মূল সুরই হচ্ছে প্রবাসীদের জীবনসংগ্রাম। দেশ থেকে দূরে থেকে, পরিবার-পরিজনের ভালো-মন্দের খবর শুনে, প্রিয়জনদের পাশে না থাকতে পারার বেদনা প্রতিটি প্রবাসী হৃদয়ে গভীরভাবে রেখাপাত করে। লেখকের দীর্ঘ প্রবাসজীবনের অভিজ্ঞতা এখানে এক বিশাল প্রেক্ষাপট হয়ে উঠেছে, যেখানে দুবাইয়ের গগনচুম্বী অট্টালিকার নিচে, মরুভূমির বালিতে, রৌদ্রদগ্ধ দিনে ও একাকী রাত্রিতে কত শত বেদনার গল্প লুকিয়ে আছে, তা তিনি চমৎকারভাবে প্রকাশ করেছেন।
এ উপন্যাস করোনাকালীন প্রবাসজীবনের এক জীবন্ত দলিলও বটে। যখন সারা বিশ্ব এক অচেনা ভয়াবহতার কবলে, তখন প্রবাসীদের জীবনে সেই ভয়াবহতার মাত্রা আরও তীব্র। মৃত্যু, অনিশ্চয়তা, স্বজন হারানোর বেদনা, দেশে ফেরার আকুতি—এসব অনুভূতি উপন্যাসের পাতায় পাতায় ছড়িয়ে আছে।
দ্বিতীয় প্রকাশ: উপন্যাসেরপ্রাসঙ্গিকতাওপাঠকপ্রিয়তা : ‘ঘরে ফেরার গান’ প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ২০২২ সালে, যখন বিশ্ব ধীরে ধীরে করোনার ভয়াবহতা থেকে বেরিয়ে আসছিল। সেই সময়ে এটি পাঠকদের হৃদয়ে গভীর দাগ কাটে এবং ব্যাপক প্রশংসিত হয়। ২০২৫ সালে বইটির দ্বিতীয় প্রকাশ এটাই প্রমাণ করে যে, এর আবেদন ও গুরুত্ব এখনো অটুট। মহামারির স্মৃতি ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে এলেও, প্রবাসজীবনের কঠিন বাস্তবতা আজও একই রকম। তাই এ উপন্যাস শুধু অতীতের একটি সময়কে ধারণ করে না, বরং বর্তমান ও ভবিষ্যতের প্রেক্ষাপটেও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক।
ভাষা ও বর্ণনার সৌন্দর্য : কামরুল হাসান জনির লেখা সাবলীল ও গভীর। সংলাপ ও বিবরণের মধ্য দিয়ে তিনি পাঠকদের এমন এক জগতে নিয়ে যান, যেখানে পাঠক নিজের চোখের সামনে দেখতে পান প্রবাসীদের জীবনসংগ্রামের প্রতিটি দৃশ্য। লেখকের নিপুণ শব্দচয়ন ও কাব্যিক বর্ণনার গুণে পাঠক প্রতিটি অনুভূতি হৃদয়ে ধারণ করতে সক্ষম হন।
উপন্যাসের আবেদন : প্রবাসীদের জীবনের না বলা কথাগুলো যারা শুনতে চান, যারা অনুভব করতে চান প্রবাসের কঠিন বাস্তবতা, তাদের জন্য ঘরে ফেরার গান অবশ্যপাঠ্য। এটি শুধু একটি উপন্যাস নয়, বরং প্রবাসজীবনের এক অকৃত্রিম দলিল, যা পাঠকের হৃদয় স্পর্শ করবে, ভাবাবে, এবং হয়তো নতুন করে প্রবাসীদের জীবনকে বোঝার সুযোগ করে দেবে।
শেষ কথা ; কামরুল হাসান জনির লেখায় সবসময়ই থাকে জীবন ও বাস্তবতার গভীর পর্যবেক্ষণ। ঘরে ফেরার গান তার লেখকসত্তার আরেকটি উজ্জ্বল নিদর্শন, যেখানে করোনাকালের কঠিন বাস্তবতার সাথে প্রবাসজীবনের নিঃসঙ্গতা ও আকুতির মিশেল ঘটেছে। বইটি নিঃসন্দেহে পাঠকদের মনে গভীর দাগ কাটবে এবং দীর্ঘদিন মনে থাকবে। দ্বিতীয় প্রকাশের মধ্য দিয়ে এটি আরও বেশি পাঠকের কাছে পৌঁছাবে এবং নতুনভাবে পাঠকের হৃদয় স্পর্শ করবে।