জীবনের আসল অর্থ খুঁজতে কোথাও বেরিয়ে পড়ে আপনি যা খুঁজে পেতে পারেন তা আমাদের দৃষ্টির মধ্যেই বর্তমান। জেন দর্শন মূলত সেই পথের দিকে আমাদেরকে ধাবিত করে যে পথে আমরা কিছু খুঁজে পেতে আকাক্সক্ষা করি। মূলত, আমরা যা খুঁজতে চাই তা হলো অভ্যন্তরীণ শান্তি যেটি অভ্যন্তরেই বিদ্যমান। তার জন্য এখন আর কোথাও আর বেরিয়ে পড়ার দরকার হয় না। যেটি খোঁজার জন্য বুদ্ধ পথে বের হয়েছিলেন।
আর্ট অব জেন বইটি সেইসব পথের নির্দেশ আমাদের সামনে হাজির করে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে জেন গুরুরা যেসব পথের দিশা আমাদেরকে দেখিয়ে গেছেন। নিজেকে খুঁজে পেতে এটি এখনও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। জীবনকে গ্রহণ করার যে পথ বুদ্ধ আমাদের শিক্ষা দেন সেসবেরই বিভিন্ন জেন গল্প বইটিতে উল্লেখ রয়েছে।
জীবনের প্রকৃত পথ খুঁজে পেতে কোনো তত্ত্ব বা উপদেশ নয়; যেন এক ধাঁধার মাধ্যমে ব্যক্তির নিজেকে খুঁজে পাবার পথ এসব জেন গল্প। জীবন নিয়ে বিভ্রান্ত থাকা পাঠকের সামনে নতুন প্রশ্ন ও উত্তরের সুলুকের সন্ধান দেবে এসব জেন গল্প।
বুদ্ধের শিক্ষার এসকল জেন গল্প পাঠের সময় মনে হবে এগুলো বেশ সহজ কিন্তু এগুলো একইসাথে এত গভীর ও বিশাল যে, উপলব্ধি করা মাত্র পাঠক বিস্মিত হবেন। শান্তি খুঁজে পাবার প্রধান পথ যে গ্রহণ করা, ক্ষমা, সহানুভূতি, সেগুলো বাস্তবায়নে পাঠক মাত্র ব্রতী হবেন এসকল গল্প পাঠে।
এ কথা তো সত্য যে, মানুষ তার জীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্য খুঁজে পেতে কেউ সারা জীবন ব্যয় করেও কোনো অর্থের সন্ধান পায় না; আবার কেউ আমাদেরই পাশে একইসাথে যেন এক গভীর অর্থপূর্ণ জীবন অতিবাহিত করে চলেছেন দিব্যি। আর্ট অব জেন এই সহজ অথচ গভীর অর্থপূর্ণ জীবনের সন্ধান দিতে আপনাকে কেবল বলবে, “জীবন বড় সহজ, শুধু একটু দেখার দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টান।”
জেন দর্শন বা গল্পের সাথে পরিচিত-অপরিচিত কাউকে এই বইটি নতুন-পুরাতন কোনো পথে ঠেলে দেবে না। এটি কেবল কিছু ভিন্নতর প্রশ্নের সন্ধান দেবে যেটি মূলত আপনি খুঁজে চলেছিলেন বলে মনে হবে। এমনও হতে পারে যেন, আপনি তাই পেয়ে যাবেন যা আপনি খুঁজছিলেন।
শান্তি না পেলে মানুষ কীভাবে বেঁচে থাকে কিংবা আসলেই কি বেঁচে থাকে? শান্তি পাওয়ার মনে প্রশ্ন আসে সঠিক পথেই চলেছে কি না। জীবনের সমস্ত মৌলিক প্রশ্ন এসব। আর্ট অব জেন এমনই সব মৌলিক প্রশ্ন ও উত্তর পাঠকের সামনে হাজির করবে। বইটি পাঠের সময় পাঠকের ভেতরে পরিবর্তন অনুভূত হবে। জীবন নিয়ে নতুন ধারণা তৈরি হবে। বইটি পাঠের পর মনে হবে, এটাই তো হওয়া দরকার ছিল।
বুদ্ধের শোনানো গল্পগুলোই আজ আমাদের জীবনের সঙ্গী। যেন এক দিশাহারা মানুষ হিসাবে আপনি এটি শুরু করবেন এবং এটি দৃষ্টিভঙ্গিতে এমন প্রভাব ফেলবে যেটি এতদিন আপনি কোথাও হাতড়ে বেড়াচ্ছিলেন।
২.
বইটি পাঠের শুরুতে মনে হতে পারে অনেককিছুই বোঝা যাচ্ছে না। গল্পের ছন্দ যেন ভিন্নÑ গল্প কোথা থেকে শুরু হলো, কী হলো শুরুতে সেসব বুঝে উঠতে পাঠক থেমে যাবেন। তারপর প্রকৃত ও গভীর মর্মার্থ উপলব্ধি করতে শুরু করবেন। প্রবেশ করবেন এক ভিন্ন জগতে। জেন গল্প আসলে সরাসরি কিছু বলে না। কোনো শিক্ষা ও দর্শন হাজির করে না। কিন্তু গল্পটি সামগ্রিকভাবে সেই গভীর অর্থ হাজির করে যা আমরা খুঁজছি।
বইটি অনুবাদের প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল শুধু গল্প শোনানো নয়, বরং পাঠকের জীবনে এক নতুন অনুভূতির সঞ্চার ঘটানো। চেষ্টা ছিল ভাষান্তরের স্রোতে যেন তার মূল রূপ হারিয়ে না যায়। পাঠক যেন সহজেই অনুভব করতে পারেন, এই গল্পগুলো কেবল কল্পনা নয় বরং এক জীবনধারা ও দর্শন। গল্পে একদিকে যেমন উঠে এসেছে বাস্তব জীবনের সংকট, তেমনি উঠে এসেছে জেন দর্শনের গভীরতাÑ শূন্যতা, মুহূর্তের সত্যতা, আত্মঅনুসন্ধান ও মানবিক সংগ্রাম। জীবনে সংকট বা যন্ত্রণা কখনোই শেষ নয় বরং প্রতি মুহূর্তে রয়েছে এক নতুন শুরু, এক নতুন অধ্যায়। গল্পের মধ্যে আছে এমন সব প্রশ্ন যেগুলোর উত্তর কখনো মেলে, কখনো মেলে না। মূল বিষয় হলো, প্রতিটি চরিত্রই বিশেষ অবস্থানে দাঁড়িয়ে নিজের জীবন, পরিচয়, সংগ্রাম নিয়ে প্রশ্ন তোলে।
প্রত্যাশা রাখি, গল্পগুলো পাঠকের হৃদয় স্পর্শ করবে, যেমন আমাকে করেছিল। গল্পের মূল অনুভূতি পাঠকের হৃদয়ে পৌঁছলে অনুবাদের আগ্রহ ও শ্রম সার্থকতা লাভ করবে।
একটা বই লেখা মানে যেন একদল মানুষের সম্মিলিত একটা যাত্রা। আমি শুধু অনুবাদকের ভূমিকায় ছিলাম, কিন্তু যাত্রাটাকে সার্থক করে তুলেছেন কিছু বিস্ময়কর মানুষ।
প্রথমেই, সেই জেন গল্প খুঁজে আনার কারিগরদের কথা বলতে হয়।তারা যেন কোনো মায়াবী নক্ষত্র সন্ধানী, যারা অন্ধকার থেকে আলো খুঁজে আনেন।তাঁদের ধৈর্য, গভীরতা আর গল্প খুঁজে আনার অদ্ভুত ক্ষমতার জন্য এই বইয়ের প্রতিটি পাতা তাঁদেরই নাম লেখা হওয়া উচিত।
তারপর রিডসি ডট কম-এর কথা না বললেই নয়। গল্পগুলোকে শব্দের রূপে সাজানো, ঠিক যেন তোলা সূতার মতো মসৃণ করে তোলা, তাদের শিল্প। তাদের নিখুঁত সম্পাদনার জন্য এই বই জীবন্ত হয়ে উঠেছে।
এবং এমাজন,যারা এই বইটিকে দিগন্ত ছাড়িয়ে পাঠকের হাতে পৌঁছে দেওয়ার সেতু তৈরি করেছে। তাদের অবদান ছাড়া, এই স্বপ্ন পূর্ণতা পেত না।
এই বইটি আসলে আমার নয়, এটা আমাদের সবার গল্প। সবার ছোঁয়া আছে এই গল্পের প্রতিটি শব্দে, প্রতিটি লাইনে। তাদের জন্য আমার হৃদয়ের
গভীর থেকে কৃতজ্ঞতা।
এই যাত্রায় যারা পাশে ছিলেন, তাদের জন্য চিরকৃতজ্ঞ।
-আসিয়া আফরিন চৌধুরী, অনুবাদক