জল তরঙ্গ এক ধরনের প্রাচীন ভারতীয় বাদ্যযন্ত্র। কয়েকটা কাঁচ বা ধাতব পাত্র পাশাপাশি সাজিয়ে রাখা হয়। একেক পাত্রে পানির পরিমাণ থাকে একেক রকম। তারপর কাঠি দিয়ে পাত্রগুলোতে নির্দিষ্ট ছন্দে টোকা দিলেই তৈরি হয় অসাধারণ বাদ্য। সুর আসে। করুণ সুর, মধুর সুর।
২০০৭ সালে যখন নাটকীয়ভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আসলো ক্ষমতায়, তখন ঢাকার আড়াই তলা বাড়িটার বাসিন্দাদের মধ্যে চলছে অন্য এক সামাজিক নাটক। ঢাকায় একান্নবর্তী সংসার ভেঙ্গে পড়ার ঝড় এসেছে। ভেঙে যাওয়া নদীর পাড়ের মতো নতুন একাধিক সংসার উঠছেন আবার অন্য কোথাও। ভাঙ্গা গড়ার বাতাসের ঝাপটা লেগেছে এ বাড়িতেও। দূরত্ব বাড়ছে; ভাইয়ের সাথে ভাইয়ের, স্বামীর সাথে স্ত্রীর, পিতার সঙ্গে সন্তানের। নিঃশ্বাসের সঙ্গে বের হচ্ছে ক্ষোভ, প্রশ্বাসের সঙ্গে ঢুকছে সন্দেহ। গৃহকর্তা আব্দুল বারী চেষ্টা করেও সংসারের ফাটল জোড়া দিতে পারছেন না। বাড়িটাকেও রক্ষা করা দুরূহ মনে হচ্ছে।
আব্দুল বারী সংসারের ফাটল জোড়া লাগাবেনই বা কীভাবে? প্রায় তিন যুগ ধরে তাঁর নিজের বুকে লালন করা চিড়টাকে কি তিনি মেরামত করতে পেরেছেন? এই যে স্ত্রী ফরিদার সাথে তাঁর অদ্ভুত সুন্দর বোঝাপাড়ার সংসার, এটাও তো অভিনয়। জল তরঙ্গ নামের বাড়িটির প্রতিটা ইটের গাঁথুনি তিনি বালু-সিমেন্টে দেননি, দিয়েছেন বিচ্ছেদ-বিরহ ও অনুতাপে। তাঁর আপাত সাধারণ ও নিরীহ জীবনের কোথায় কোন সত্য ও রহস্য লুকিয়ে আছে, জানলে বিশ্বাস করবে কেউ? চার সন্তানের মধ্যে ফরহাদের প্রতি তাঁর পক্ষপাত কেন এত বেশি, এর কারণ কি তিনি তবে বলে দেবেন? ফরিদাও কি বলে দেবেন যে স্বামীর যত্ন করে লুকানো সব তিনি জানেন? সাজ্জাদ কেন সব সময় রেগে থাকে, এই রহস্যের উদঘাটন হবে? ফরহাদের ছোট্ট ও সহজ একটা অনুরোধ রাখতে গিয়ে বুক কেন ভেঙে যাবে তার মেজ ভাবী বিথীর?
ও হ্যাঁ, এত নাম থাকতে বাড়িটার নামই বা কেন "জল তরঙ্গ" রাখলেন? এই বাড়ির প্রতিটা মানুষ একেকটা পানির পাত্র যে সুর তৈরি করেছে, সেটা আসলে কেমন হলো শেষ পর্যন্ত?
সবচেয়ে বড় কথা, কেউই তো জানল না জল তরঙ্গের সুরটা আসলে বাজিয়েছে কে এবং সে এখন কোথায় আছে। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে আব্দুল বারী তাঁর জীবনের মহাসত্যটা কাউকে জানাবেন না সব গল্পকে কবর দেবেন নিজের সঙ্গে?
আর সবশেষে, ফরহাদ কি তার স্বপ্নের ইউরোপে যেতে পারবে? নাকি বরাবরের মতোই ব্যর্থ হবে আবার? ব্যর্থ হলে তো বাড়ি ফেরার কথা। কিন্তু কেন মনে হচ্ছে ইউরোপ যেতে না পারলেও সে আর হয়তো কোনোদিন জল তরঙ্গে ফিরবে না?
অজস্র প্রশ্নের সকল উত্তর মিলবে উপন্যাসের শেষ পৃষ্ঠায়।
ও হ্যাঁ, এতগুলো মানুষের জীবনের এত সব প্রশ্নের উত্তর কি আদৌ পাওয়া সম্ভব?
সিলেটের সীমান্তবর্তী জকিগঞ্জ উপজেলায় জন্ম। গ্রামের স্কুল ও কলেজ পার করে স্নাতক করেছেন ঢাকার শহীদ সোহওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের ডেন্টাল ইউনিটে। সীমান্তবর্তী মানুষের বিচিত্র ও সংগ্রামের চিত্র দেখে প্রথম জীবন ও তার রূপ রসের ব্যাপারে ধারণা পেয়েছেন। গণমানুষের জগত ও অনুভূতির জগতে তারপর নিজের অজান্তেই অনুপ্রবেশ করেন। লেখক জীবন এখনো সংক্ষিপ্ত, তবু তিনটা পর্যায় চলে এসেছে এই অধায়ে। ফেসবুকে নিয়মিত গল্প লেখার পর ২০১৮ সালে লিখেন প্রথম উপন্যাস “শিকল”। পরের বছরে প্রকাশিত হয় তার লেখা ইতিহাস নির্ভর রাজনৈতিক উপন্যাস “বিভ্রম”। দুই উপন্যাসে গ্রহণযোগ্যতা পাবার পর “ত্রিকোণমিতা” উপন্যাস ও গল্পগ্রস্থ “বেঁচে থাকার গান” প্রকাশের পর নিয়েছেন পাঁচ বছরের নাতিদীর্ঘ বিরতি। সাময়িক বিরতি শেষে ২০২৫ সালের বইমেলায় প্রকাশিত হবে তার দুটি উপন্যাস “বাড়ির নাম জল তরঙ্গ” এবং “লক্ষ্মণরেখা”। মূলধারায় লেখার পাশাপাশি জয়নাল আবেদীন টেলিভিশন চিত্রনাট্য, কন্টেন্ট ও কপি রাইটিং, অনুলিখন জাতীয় লেখালেখির বিভিন্ন মাধ্যমে যুক্ত আছেন। বাংলাদেশে শুধুমাত্র লেখালেখিকে পেশা হিসেবে নেয়া দুরূহ কাজ। জয়নাল আবেদীন আশা করেন, কোনো একদিন তিনি এই দুরূহ অসাধ্যটি সাধন করতে পারবেন।