পূর্বরঙ্গ
আমার যখন ছয় বছর বয়স তখন আমি রাঁধুনি হতে চেয়েছিলুম। সাত বছর বয়সে হতে চেয়েছিলুম নেপোলিয়ান। সেই তখন থেকে আমার উচ্চাকাক্সক্ষা বেড়েই চলেছে।
ছয় বছর বয়সে রান্নাঘরে ঢুকে খাওয়া ছিল অপরাধ। বাড়ির ওই অংশে যাওয়া সুস্পষ্টভাবে নিষিদ্ধ করে দিয়েছিলেন আমার বাবা-মা। তবুও ঢুঁ মারতুম আর চাকরানিরা প্রশ্রয়ে চেঁচিয়ে উঠতো।
রান্নাঘরে প্রবেশাধিকার ছাড়া আর সবকিছু করার স্বাধীনতা ছিল। স্রেফ আনন্দে মাতোয়ারা হবার জন্যেই আট বছরে পৌঁছোলুম। আমি ছিলুম বাড়ির সম্রাট। কিছুতেই আমার আশ মিটতো না। মা-বাবা তো পুজো করতেন আমায়।
আমার জন্মের তিন বছর আগে আমার ভাই সাত বছর বয়সে মেনেঞ্জাইটিস রোগে মারা গিয়েছিল। ওর মৃত্যুতে একেবারে ভেঙে পড়েছিলেন মা-বাবা। আমি আসার পরেই ওনারা সান্ত্বনা পেলেন।
মার্কামারা বিপথগামী অধিদেবতা বলতে যা বোঝায়, আমি ছিলুম ঠিক তাই। বজায় রেখেছিলুম খোকাজগতের যাবতীয় দুর্বুদ্ধিময় স্বর্গ : সীমাহীন স্বেচ্ছাচারী আগ্রহে আঁকড়ে ধরতুম যে কোনও আনন্দ, আর সামান্য প্ররোচনায় হয়ে উঠতুম বিপজ্জনক।
আজকে আমরা জানি যে ফর্ম হল বস্তুর তদন্তমূলক প্রক্রিয়ার ফলাফল-বস্তু যখন চারিদিকের প্রচণ্ড চাপ সহ্য করে আকৃতি পায়, বের করে আনে ঠেসে ধরার পর। তার প্রতিক্রিয়ার মৌলিকতায় নিজের জীবন থেকে ফেটে বেরিয়ে কিনার বরাবর নিখুঁত সীমায় পৌঁছোয়।
অকীক মণির ঝলমলে বিকাশের তুলনায় আর কী-ই বা হালকা আর আকর্ষক হতে পারে। তেমনিই গোলাপ! প্রতিটি ফুল ফুটে ওঠে এক কারাগারে। নান্দনিক দৃষ্টিতে মুক্তি ব্যাপারটা হল ফর্মহীনতা।
ওই বয়সে আমাকে প্রতিটি জিনিস রূপান্তরিত করতো। কিছুই পরিবর্তন ঘটাতে পারতো না। আমি ছিলুম নম্র, ভিতু, আর দোনামোনা। আমার বাবা-মা আমার ভাইয়ের নামেই নামকরণ করেছিলেন-সালভাদোর-আর আমার ভবিতব্য, যা আমার নাম থেকেই টের পাওয়া যায়, আধুনিকতাবাদী শিল্পভাবনা থেকে ছবি আঁকাকে উদ্ধার করার কাজ আমার ওপর বর্তেছিল, আর তা এমন এক যান্ত্রিক আর হেলাফেলা যুগের ধ্বংসাবশেষে যাতে আমরা বেঁচে থাকতে বাধ্য।
আমাদের বাড়ির তিনতলায় থাকতেন আর্জেনটিনীয় পরিবার মাতাস, যাঁদের এক মেয়ে, উর্সুলিতা, ছিলেন অসাধারণ সুন্দরী। সাত বছরে পৌঁছোবার পরই, তিনতলার যৌনসামাজিক আকর্ষণ ঘিরে ধরতো আমায়। বাড়িতে যেমন, তিনতলাতেও তেমন আদর পেতুম। ওখানে প্রতিদিন ছ’টা নাগাদ, সেদ্ধ শুয়োর সাজানো বিরাট এক টেবিলের চারিধারে রূপবান-রূপবতী প্রাণীরা আর্জেনটিনীয় দেবদূতদের উচ্চারণে কথা বলছে আর চা খাচ্ছে। এই বাচনিক যৌনাচার আমায় অদ্ভুতভাবে বিপর্যস্ত করতো আর আমার অন্তরজগতে গড়ে তুলতো নৈতিক ঘূর্ণিঝড়ের বিপদ। তাতে ঝিকমিক করতো নীলাভ ঈর্ষার হীরকখণ্ড। টেবিলের মাঝখানে রাখা চায়ের কেটলিতে আঁকা ছিল নেপোলিয়ান।
নেপোলিয়ানের ওই ছোট্ট ছবি দখল নিয়ে নিয়েছিল আমার আত্মা, যা অবয়ব পায়নি তখন পর্যন্ত, অনেকটা চাটুতে ভাজা ডিমের কুসুমের মতন। এইভাবেই, এক বছরের মধ্যে রাঁধুনি থেকে নেপোলিয়ানের ক্রমোচ্চ শ্রেণী বিভাজন প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছিলুম। পরে আমার আবিষ্কৃত চিন্তাযন্ত্রগুলোর বিষয়ে বিশদে বলবো, তার মধ্যে অন্যতম হল ভক্ষণীয় নেপোলিয়ান, যাতে আমি বালকবয়েসের দুটি জরুরি মায়া খুঁজে পেয়েছিলুম-পুষ্টিকর মৌখিক আহ্লাদ এবং চোখে ধাঁধাঁ লাগানো আধ্যাত্মিক আধিপত্য।