মার্কিন প্রবাসী সেজান মাহমুদ বর্তমান যুগের বাংলা সাহিত্যে এক জনপ্রিয় নাম যিনি তাঁর লেখার মাধ্যমে ছোটো-বড়ো সব বয়সি পাঠকের মনে এক বিশেষ জায়গা করে নিয়েছেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখার পাশাপাশি বিজ্ঞাননির্ভর অ্যাডভেঞ্চার সিরিজ শুরু করেছিলেন সেই ১৯৯২ সাল থেকে।
এই সিরিজের প্রথম গ্রন্থ ‘দ্বীপ পাহাড়ের আতঙ্ক’। প্রাকৃতিক উৎস সামুদ্রিক গ্যাস থেকে শক্তি উৎপাদনের যে কথা এখন পত্রপত্রিকায় দেখা যাচ্ছে, সেই গ্যাস হাইড্রেড নিয়ে ১৯৯২ সালেই লিখেছিলেন ‘দ্বীপ পাহাড়ে আতঙ্ক’; এক ক্ষমতালোভী বিজ্ঞানীর কুপরিকল্পনাকে নস্যাৎ করে দিয়েছিলেন ছোটকা আর নিশু, বাংলাদেশের মাটিতে, মহেশখালির দ্বীপে।
ছোটকা-নিশুর অ্যাডভেঞ্চার দ্বিতীয় গ্রন্থ ‘তুষার মানব’ প্রথম প্রকাশিত হয় বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত ‘ধান শালিকের দেশ’ পত্রিকা এবং গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় ১৯৯৪ সালে। অস্ট্রিয়ার হিমবাহের নীচে খুঁজে পাওয়া প্রায় পাঁচ হাজার বছরের পুরোনো মানুষের মৃতদেহ নিয়ে এক রোমাঞ্চকর অ্যাডভেঞ্চার উপন্যাসের মধ্যে তুলে আনা হয়েছে মানুষের জিনেটিকে বা বংশগতিবিদ্যার সুকঠিন বিষয় একেবারে কিশোর মনের উপযোগী করে। এরকম আধুনিকতা, বিজ্ঞানমনস্কতা, বাস্তববাদিতা আর কল্পনার বিশালতা নিয়ে সচেতনভাবে লেখার কাজ বাংলা শিশু-কিশোর সাহিত্যে খুব কম লেখকই করেছেন। আর স্বতন্ত্র স্বাদু গদ্যের অধিকারী এবং নিজে চিকিৎসাবিজ্ঞানী হওয়ায় এক অনায়াস সহজিয়ায় এই গুরুগম্ভীর বিষয়গুলো আমাদের তরুণ প্রজন্মের কাছে উপস্থাপন করেন তিনি।
নিজস্ব উচ্চশিক্ষা আর পেশার কারণে দীর্ঘ বিরতি হলেও আবার ছোটকা-নিশুর অ্যাডভেঞ্চার নিয়ে তিনি হাজির হয়েছেন পাঠকের সামনে; এবারে একেবারে আনকোরা নতুন উপন্যাস ‘ফেসবুকের বন্ধু’ নিয়ে। এই উপন্যাসেও উঠে এসেছে আধুনিকতম বিষয়—বায়োটেরোরিজম।
এই তিনটি উপন্যাস নিয়ে ‘বিজ্ঞান নির্ভর অ্যাডভেঞ্চার সমগ্র ১’ । বাংলা শিশু-কিশোর সাহিত্যে এই গ্রন্থ একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন।
সেজান মাহমুদ, পেশাগত নাম সালেহ মো. মাহমুদুর রহমান। ঢাকা থেকে এম.বি.বি.এস পাশ করার পর আমেরিকার বিশ্বখ্যাত হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এন্ডোক্রাইনোলজিতে ফেলোশিপ, জনস্বাস্থ্যে এম.পি.এইচ এবং বার্মিংহাম থেকে জনস্বাস্থ্যের ওপরে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন। সাহিত্যে তাঁর বিচরণ বহুবিধ ক্ষেত্রে। তাঁর নিরীক্ষাধর্মী উপন্যাস ‘অগ্নিবালক’ (২০০৯) প্রকাশিত হলে সৃজনশীল ও মননশীল লেখক মহলে নতুনধারার লেখা হিশেবে প্রশংসিত হয়। তার লেখা বাংলাদেশ টেক্সট বুক বোর্ড কর্তৃক ষষ্ঠ শ্রেণির জাতীয় পাঠ্য বইতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে বাংলা সাহিত্যের দিকপালদের পাশাপাশি (১৯৯৬)। মুক্তিযুদ্ধে নৌ-কমান্ডোদের গৌরবজনক ভূমিকার অকথিত সত্যি ঘটনা নিয়ে তাঁর লেখা ‘আপারেশন জ্যাকপট’ ১৯৯১ সালে প্রকাশিত হলে সুধীমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়। বাংলাদেশ টেলিভিশন এবং বেতারের গীতিকার হিসেবে লিখেছেন অনেক জনপ্রিয় গান। প্রকাশিত গ্রন্থ: অগ্নিবালক (উপন্যাস), হারাম ও অন্যান্য গল্প (গল্পগ্রন্থ), হার্ভার্ডের স্মৃতি ও অন্য এক আমেরিকা (স্মৃতিকথা), পথ হারানোর পথ (কলামসমগ্র-১); মুক্তিযুদ্ধের কিশোর রচনাসমগ্র-১, বিজ্ঞান নির্ভর অ্যাডভেঞ্চার সমগ্র-১, প্রোজেক্ট ভূতং আধুনিকং (গল্পগ্রন্থ), হাবিজাবি (ছড়া), তুষারমানব, দ্বীপ পাহাড়ে আতঙ্ক, বিশ্বের শ্রেষ্ঠ দশ অভিযাত্রী, কিশোর রহস্য গল্প, পালটে শুধু লেবাস, ও ছড়ায় ছড়ায় সায়েন্স ফিকশন। পুরস্কার: বাংলাদেশ শিশু একাডেমি কর্তৃক প্রদত্ত অগ্রণী ব্যাংক শিশু সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৮)। আমেরিকান এসোসিয়েশন ফর ক্যান্সার রিসার্চ ফ্যাকাল্টি স্কলার এওয়ার্ড (২০০৮, ২০১০), আমেরিকান পাবলিক হেলথ এসোসিয়েশন ‘আরলি ক্যারিয়ার এওয়ার্ড (২০০৬), আওয়ার প্রাইড এওয়ার্ড (২০০৫), অ্যালাবামা পাওয়ার ফাউন্ডেশন আউটস্ট্যান্ডিং অ্যাচিভমেন্ট এওয়ার্ড (২০০০), ইন্টারন্যাশনাল ডায়াবেটিস ফেডারেশন ফেলোশিপ এওয়ার্ড (১৯৯৬)। বর্তমানে আমেরিকার ইউনিভার্সিটি অব সেন্ট্রাল ফ্লোরিডা কলেজ অব মেডিসিনে সহকারী ডিন এবং মেডিক্যাল এডুকেশনের অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন। স্ত্রী চিকিৎসক ও অভিনয়শিল্পী তৃষ্ণা মাহমুদ, পুত্রদ্বয়- তিশিয়ান মাহমুদ এবং রেনোয়া মাহমুদকে নিয়ে বাস করছেন আমেরিকার ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যে।