টিপ টিপ বৃষ্টি নিয়ে দিন শুরু হলেও বেলা শেষে এমন অঝোর ধারায় শুরু হয়েছে যে উঠানে পানি জমে গেছে। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে নিরুকে রিকশা পেতে দেখলেন রাহেলা বেগম। রাহেলা বেগমের চাচাতো বোন নিরু। কাছেই থাকে। নিউমার্কেট এলাকায় বাসা। ছোটবেলায় একসাথে হেসেখেলে মানুষ নিরু ও রাহেলা বেগম। বড় হয়ে সংসারী হয়েও সেই সম্পর্কে ফাটল ধরেনি। এমনকি চল্লিশে পা দেওয়া রাহেলা বেগমের মনে সেই ছোটবেলার ভালো লাগা নিরুকে কাছে পেলে এখনো অনুভব করেন। নিরু শায়লার একটা বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছে। ছেলে এ বছর ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে বের হয়েছে। পাস করার ছয় মাসের মাথায় চাকরিও পেয়েছে। নিরুর বাসার ভাড়াটের ছেলে। ছেলেকে রাহেলা বেগমও চেনেন।
রাহেলা বেগম রাজি থাকলে ছেলের বাবা বিয়ের প্রস্তাব পাঠাবেন—সে কথা বলতেই এসেছিল নিরু।
বারান্দার রেলিং ধরে বিষণ্ন মনে বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে রাহেলা বেগম ভাবছেন, শায়লা এই বৃষ্টির মধ্যে বাসায় ফিরবে কী করে?
কত দায়িত্ব এই ছোট্ট মেয়েটির। বৃষ্টি মাথায় নিয়ে সেই সকালে বের হয়েছে। এখন প্রায় পাঁচটা বাজে। আরও আগে আসার কথা। এখনো ফিরল না বলে চিন্তা হচ্ছে রাহেলা বেগমের। দূর থেকে যে রিকশাই চোখে পড়ে, সাথে সাথে মন আশান্বিত হয়ে ওঠে, এটায় শায়লা আছে। গেট পার হয়ে গেলেই মনটা চুপসে যায়। আবার আরেকটা রিকশা আসার অপেক্ষা।
এই অপেক্ষার শেষ কোথায়, রাহেলা বেগম জানেন না।
মনে হয়, এই তো সেদিনের কথা। ক্লাস নাইনে পড়ে রাহেলা। স্কুল থেকে বাসায় এসে দেখল, তার একমাত্র ফুফু এসেছেন। ফুফু নিঃসন্তান। তাঁর সাথে একটি ছেলে এসেছেন। ছেলেটি ফুফুর ভাশুরের ছেলে। সুদর্শন, মুখে চাপদাড়ি, বয়সে তরুণ। নাম শামসুল আলম। একটি ইটভাটার ম্যানেজার। শামসুল আলমের বাবা মৃত। মা অসুস্থ। মা তাই ছেলের বউ দেখতে চান। রাহেলার ফুফু তাঁর বড় জা-কে রাহেলার কথা বলেছেন।
শামসুল আলমের মা বলেছেন, ছোটবেলা থেকে ছেলেকে কোলেপিঠে করে তোমরা স্বামী-স্ত্রীতে মিলে বড় করেছ। ছেলের বিয়ে করানোর দায়িত্বও তোমাদের দিলাম।
উত্তরে রাহেলার ফুফু বলেছেন, বুবু, রাহেলা বড় ভালো মেয়ে। কিন্তু গায়ের রং আপনার ছেলের মতো অত ফরসা নয়।
রাহেলা দেখতে শ্যামলা। দোহারা গড়ন। মাথাভর্তি কালো চুল। সব মিলিয়ে দেখতে ভারি মিষ্টি। আমার ভাইজি বলে বলছি না। এই শ্যামলা মেয়েটি যে সংসারে যাবে, সেই সংসারকে আলোকিত করে তুলবে।
রাহেলার মা-বাবার সাথে আগেই কথা বলে রেখেছিলেন ফুফু। তাই সেদিন রাতেই শামসুল আলমের সাথে রাহেলার বিয়ে হয়ে গেল।
বউ দেখে শাশুড়ি ভীষণ খুশি। বললেন, বউমা, আমার একটিমাত্র ছেলে। তুমি নাতি-নাতনি দিয়ে আমার ঘর ভরিয়ে তুলবে।
রাহেলা লজ্জায় মুখ তুলে তাকাতে পারেনি। তবে কালে-দিনে শাশুড়ির কথাই ফলেছে। ঘর আলো করে প্রথমে পরির মতো ফুটফুটে মেয়ে শায়লা কোলজুড়ে এসেছে। বাবার গায়ের রং নিয়ে জন্মেছে শায়লা। এক এক করে আরও চারজনের জন্ম হয়েছে। শায়লার পরে যার জন্ম, তার নাম নায়লা। এরপর যমজ দুই মেয়ের জন্ম হয়েছে। তাদের নাম রেখেছে সেতু ও মিতু। সবশেষে ছেলে হয়েছে। তার নাম রনি। দাদি তাদের দেখে যেতে পারেননি। শাশুড়ি প্রথম নাতনির নাম রেখেছিলেন শামসুল আলমের সাথে মিলিয়ে—শায়লা। বাবা-দাদির অনেক আদরের শায়লা। জন্মের প্রথম দিনেই শায়লাকে কোলে নিয়ে বাবার কত আদরের কথা! তা দেখে সবার সে কী হাসাহাসি!
ছেলেমেয়েরা শামসুল আলমের জানের টুকরা ছিল। তারা যে আবদার করত, সাধ্যানুযায়ী সে তা পূরণ করার চেষ্টা করত। রাহেলা বেগম বলত, একটু হিসেব করে খরচ করেন। দুঃসময়ে কাজে দেবে।
শামসুল আলম প্রাণখোলা হাসি হেসে বলত, দুশ্চিন্তা কোরো না, শায়লার মা। আমি যতক্ষণ বেঁচে আছি, তোমাদের কোনো ভাবনা নেই।
রাহেলা বেগম বলত, ভাবনার কি কোনো আগা-মাথা আছে? এতজন ছেলেমেয়ে, ভাবনা তো থাকবেই।