“জুলাই বিপ্লব : কোটা সংস্কার থেকে রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন” বইটি ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে শুরু করে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে বাংলাদেশের ইতিহাসে ঘটে যাওয়া এক নজিরবিহীন গৌরবোজ্জ্বল ঘটনা অবলম্বনে রচিত। এই বইটিতে দীর্ঘ পনেরো বছর ধরে একটি জাতির ওপর অন্যায়-অবিচার, জুলুম-নির্যাতন, শোষণ-বঞ্চণা, বিভেদ-বৈষম্যের ইতিহাসের খলনায়ক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে গণজাগরণ ও সংগ্রামের মহাকাব্যিক চিত্র কলমের কালিতে সুচারুরূপে উপস্থাপন করার প্রচেষ্টা মাত্র। ২০২৪ সালের জুলাই এবং আগস্ট মাসের আন্দোলন শুধু কোটা সংস্কারের জন্য ছিল না, বরং এটি আস্তে আস্তে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে পরিণত হয়েছিল জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য একটি ঐতিহাসিক বিপ্লবে। কোটা সংস্কার আন্দোলনে ছাত্র-জনতার জীবনবাজি রেখে যে গণজাগরণের সূচনা হয়েছিল, তা পরিণত হয়েছিল স্বৈরাচারবিরোধী গণঅভ্যুত্থানে। যে গণঅভ্যুত্থানে যুক্ত হয়েছিলেন নারী-পুরুষের সমন্বয়ে আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা। নারী-পুরুষের সম্মিলিত আন্দোলনে শহীদদের রক্তে রাঙানো রাজপথ, স্কুলপড়ুয়া শিশুদের বুকের তাজা রক্ত আর ছাত্র-জনতার সাহসী স্লোগানে মুখরিত এক নতুন সূর্যের প্রত্যাশা নিয়ে অজানা গন্তব্যের পথে ধাবিত হয়েছিলেন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মতো ২০২৪ সালেও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে বিপ্লবের প্রতিটি অধ্যায় আমাদের জাতীয় চেতনায় নতুন করে যুক্ত হয়েছে। সৃষ্টি হয়েছে নতুন বাংলাদেশের।
এই বইটিতে সেই সংগ্রামের ধারাবাহিক ঘটনাবলি বিভিন্ন জাতীয় ও স্থানীয় পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের তথ্য-উপাত্তের মাধ্যমে সাবলীলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। এতে কোটা সংস্কার থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এমনকি রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের প্রতিটি ধাপ সবিস্তারে বর্ণনা করা হয়েছে। “তুমি কে, আমি কে? রাজাকার, রাজাকার”, “কে বলেছে, কে বলেছে?Ñ স্বৈরাচার, স্বৈরাচার” স্লোগান যেমন উত্তাল করেছিল রাজপথ, তেমনি রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদের শাহাদাত এবং শহিদদের আত্মত্যাগ প্রজন্ম থেকে প্রজন্মকে অনুপ্রেরণা দিয়ে যাবে। স্বৈরাচার সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় কারফিউর নিস্তব্ধ দিনগুলো, ইন্টারনেট বন্ধ করে আন্দোলন দমনের অপচেষ্টা, বাবার কোলে গুলিবিদ্ধ শিশু, ঘরের বারান্দায় বসে থাকা নারী গুলিবিদ্ধ হয়ে হত্যাকাণ্ডের শিকার ইত্যাদি ঘটনা যেন এক নির্মম অধ্যায়ের সাক্ষী। এ আন্দোলনে প্রায় দু’হাজার ছাত্র-জনতা শহিদ হয়েছেন এবং প্রায় ত্রিশ হাজার বিপ্লবী আহত কিংবা পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন।
এ বিপ্লবের সাফল্যের পিছনে মুখ্য ভ‚মিকা পালন করেছিলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত, ছাত্র সমাজ, গণতন্ত্রকামী বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের সমর্থন ও সক্রিয় অংশগ্রহণ, পোশাক শ্রমিক, রিকশাচালক থেকে শুরু করে সকল শ্রেণি পেশার মানুষ।
“জুলাই বিপ্লব : কোটা সংস্কার থেকে রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন” বইটি ২০২৪ সালের স্বৈরাচার হটানোর একটি দালিলিক গ্রন্থ হিসেবে আখ্যায়িত করলে ভুল হবে না। প্রতিটি তথ্য-উপাত্ত বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকা হতে সংগ্রহ করা এবং তা নির্ভুলভাবে যাচাই করা হয়েছে। এতে ২০২৪ সালে ঘটে যাওয়া স্মরণকালের গণ-অভ্যুত্থানের ইতিহাসের পাশাপাশি শহিদদের আত্মত্যাগ, বলিষ্ঠ নেতৃত্বের দায়িত্বশীলতা এবং সাধারণ মানুষের অক্লান্ত প্রচেষ্টার গল্প তুলে ধরা হয়েছে। পুলিশ প্রশাসন থেকে শুরু করে সিভিল প্রশাসনের ন্যাক্কারজনক ভ‚মিকা, সবশেষে সেনাবাহিনীর ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত, গণভবন অভিমুখে গণমিছিল এবং ৫ আগস্টে শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও পালানোর ঘটনাগুলো এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে। যা চ‚ড়ান্তভাবে অবতীর্ণ হয় বিপ্লবী ছাত্র-জনতার বিজয়ের পর ড. মুহাম্মদ ইউনুস-এর নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অভিষেক এবং নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে।
এই বইটি কেবল অতীতের স্মৃতি সংরক্ষণ নয়, বরং একটি জাতির ভবিষ্যত নির্মাণের জন্য প্রেরণার উৎস। কোটা সংস্কার থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে সংঘটিত ‘জুলাই বিপ্লব’ আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন কীভাবে একটি জাতিকে পতিত স্বৈরাচারের হাত থেকে পুনর্গঠনের পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। এই বইটি একটি আত্মপরিচয়ের আয়নাস্বরূপ, যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে গণতন্ত্র, স্বাধীনতা এবং মানবিক মর্যাদার জন্য লড়াই করার শক্তি জোগাবে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে মানুষের বাকস্বাধীনতা ও রাজনৈতিক অধিকার ফিরলেও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, জুলাই হত্যাকাÐের বিচার, আহতদের চিকিৎসা, রাষ্ট্র সংস্কারে ধীরগতি নিয়ে কিছুটা হতাশা ও অস্বস্তিতে বিপ্লবী ছাত্র-জনতা। আমলাতন্ত্র ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সামাল দিতে না পারলে ব্যর্থ হতে পারে গণ-অভ্যুত্থানের আকাক্সক্ষা। সেই আশঙ্কায় আজও ছাত্র-জনতা রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন থেকে পিছু হটেননি।