আমরা বাস করছি উত্তরাধুনিক কালের পরিসরে। আধুনিকতার আদিপর্ব, মধ্যমপর্ব, বিকাশপর্ব আর অতি আধুনিক পর্ব পেরিয়ে উত্তরাধুনিক কালপর্বের নতুনত্বকে ধারণ করেই আমরা অনিবার্য ভবিষ্যতের দিকে অগ্রসরমান।উত্তরাধুনিক সমাজবাস্তবতা হলো হাইপার রিয়েলিটি, ভার্চুয়াল রিয়েলিটি ও ম্যাজিক রিয়েলিটি। আধুনিকোত্তর সমাজে বহুমাত্রিক মানুষেরা নির্মাণ ও বিনির্মাণে সক্রিয়।বর্তমানের সংকটময় বিকাশকালকে নানামাত্রিক প্রবণতায়, বহুস্বরে ও বহুকণ্ঠে, অনেকান্তুিক ব্যাখ্যায় এবং বহু দৃষ্টিকৌণিকতা পুনর্গঠন, সংস্কার ও নবায়নের প্রচেষ্টা চলছে। এক মহাসত্য অপেক্ষা বহু সত্যে আস্থাবান উত্তরাধুনিকতা। মানবচেতনার জাগরণ, বিপ্লবের ধারায় সামাজিক নবজাগরণ, আর্থ-সামাজিক পুনর্জাগরণ ও সাংস্কৃতিক মহাজাগরণ সম্ভব হয়েছে। এ জাগরণ আজ বহুরৈখিক জটিলতা ও দৃষ্টিভঙ্গির প্রেক্ষাপট উন্মোচনে উন্মুখ হয়েছে উত্তরাধুনিক চিন্তন-প্রক্রিয়ায়।উত্তরাধুনিক মানুষ ডিজিটাল বিপ্লব, জৈব-প্রযুক্তির বিপ্লব এবং চেতনার বহুমাত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করেছে।স্বাধীনতায় এবং মুক্তপরিসরে ক্রমাগত বিনির্মাণ ও নতুন কিছু সৃষ্টির চাঞ্চল্যে উন্মুখ উত্তরাধুনিকতা। উত্তরাধুনিকতা সবকিছু ভাঙতে চায়, সংস্কার করতে চায়। নানামুখী বর্ণনা, বিশ্লেষণ ও দৃষ্টিভঙ্গি অবলম্বনে উত্তরাধুনিকতা পুনর্গঠন করতে চায় যাবতীয় ডিসকোর্স, ন্যারেটিভ ও টেক্সটগুলোকে। সবকিছু পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে যাচাই করতে চায়, আগাগোড়া বাজিয়ে দেখতে চায়, সমগ্রকে ভেঙে খন্ডিতভাবে বিশ্লেষণ করতে চায় উত্তরাধুনিকতা। ‘উত্তরাধুনিক বাংলা উপন্যাস কালের মহাকাব্যিক আখ্যান’ গ্রন্থে রয়েছে বাংলা ভাষার পনেরোজন শক্তিশালী লেখকের পনেরোটি ব্যতিক্রমী মহাকাব্যিক মানবিক আখ্যান। চেনা ছকের বাইরে এই উপন্যাস গুলির কাহিনী গড়ে উঠেছে বাস্তবতার উপাদানের মিশেলে।উত্তরাধুনিক এই উপন্যাস গুলিতে লেখকগণ নিজেদের লেখার মুন্সিয়ানায় ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন বাস্তবতার উপাদান দিয়ে পরাবাস্তবতার ভুবন। যা পাঠককে আলোড়িত করে এবং একই সঙ্গে পাঠকের মনে একটা অদ্ভুত ভালোলাগার ঘোর তৈরি করে।শওকত আলীর ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ ঐতিহাসিক উপন্যাসটি ভিন্ন ধারার,নিম্নবিত্ত অনুল্লেখযোগ্য গ্রামীণ সমাজের মানুষ নিয়ে রচিত।এই উপন্যাসে তিনি বিশ শতকের প্রায় শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে সুদূর পেছন পানে তাকিয়ে ইতিহাসের এক সন্ধিক্ষণের শিল্পভাষ্য রচনা করেছেন।লক্ষ্মণ সেনের রাজত্বকালের শেষ বছরগুলোতে দুর্বলতার সুযোগে তুরস্কের মুসলমান অভিযানকারী বখতিয়ার খলজি অনায়াসেই বাংলা দখল করে নেন।ধর্মের নামে অধর্ম, সামাজিকতার বদলে অসামাজিকতা, সংস্কৃতির স্থানে অপসংস্কৃতি আচ্ছন্ন করে রেখেছিল এই সময়ের বাংলাকে।প্রদোষ বলতে মুসলিম বিজয়পূর্ব বাংলার সমাজ চিত্রের বর্ণনায় ঔপন্যাসিক শওকত আলী যে ইতিহাস অঙ্কন করেছেন তাতে ইতিহাস সমান্তরালেই কাহিনী এগিয়েছে।সমকালীন মানুষ, মানুষের পেশা, জনপদ, গ্রাম-শহর, নদ-নদী, প্রকৃতি এবং চরিত্রের সংলাপ সমস্তের বর্ণনায় যে আবহ সৃষ্টির প্রয়াস লক্ষ্য করা যায় তাতে মনে হয়, শওকত আলী কল্পনায় হাজার বছর পূর্বের বাংলায় নিয়ে যেতে চেয়েছেন পাঠককে।রবিশংকর বলের “দোজখনামা”পরাবাস্তব আবহে দুই উন্মুল মানুষ গালিব ও মান্টোর মর্মস্পর্শী কিসসা।উপন্যাসের এক নতুন সম্ভাবনার দিগন্ত উন্মোচিত করেছেন রবি শংকর বল তাঁর ব্যতিক্রমী উপন্যাস দোজখনামা’য়।’ কবরে শুয়ে আলাপ, গল্প বলা, নিজেদের জীবনের নানা ঘটনা ও স্মৃতিচারণ করে যান কবি মির্জা গালিব ও গল্পকার সাদাত হাসান মান্টো।ইতিহাসের পট পরিবর্তনের বিভিন্ন বাঁকে দুই শতকের দুই জন কবি ও গল্পকারের সময় কি করে দোজখখানা হয়ে ওঠে তার চিত্রায়ন আসে ‘দোজখনামা’য়।সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের ‘অলীক মানুষ’ উনিশ-বিশ শতকে লৌকিক-অলৌকিকের মন্ময় আখ্যানে রচিত বাঙালি হিন্দু মুসলমান জীবনে এক অনাবিষ্কৃত এক সত্যের উদ্ভাসন।‘অলীক মানুষ’ উনিশ-বিশ শতকের মুসলিম অন্দর মহলের এক প্রামান্য কাহিনীচিত্র।বাঙালি হিন্দু মুসলমান জীবনে এক অনাবিষ্কৃত এক সত্যের উদ্ভাসন।তিনি নিমোর্হভাবে তাঁর সহজাত ভাষায় বুনেছেন অসংখ্য কাহিনী-উপকাহিনীর মধ্যে দিয়ে একটি মহাকাব্যিক উপন্যাস।একশ বছরের এই লৌকিক-অলৌকিকের মন্ময় আখ্যানটি রচিত হয়েছে কোলাজ রীতিতে।দেশভাগের মর্মস্পর্শী মানবিক উপাখ্যান সুনন্দা সিকদারের ‘দয়াময়ীর কথা’।দেশবিভাগ শুধু দুইবাংলাকে খণ্ডিত করে গিয়েছে তা নয়,লক্ষ লক্ষ মানুষকে সর্বার্থে ছিন্নমূল করেছে। সেই ক্ষত থেকে আজ আর রক্ত পড়ে না বটে, কিন্তু সেই বেদনা আজও অশ্রুপাত ঘটায়, তার থেকেই জন্ম হয় “দয়াময়ীর কথা”র মতো অবিস্মরণীয় সাহিত্যকীর্তির।সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ উপন্যাসের নতুন ধারা চৈতন্যপ্রবাহ রীতিতে লেখা ‘কাঁদো নদী কাঁদো’ এক ব্যতিক্রমধর্মী উপন্যাস।নদী শুকিয়ে যাওয়াকে কেন্দ্র করে মানুষের বিপন্নতাকে লেখক যাদুবাস্ততায় ফুটিয়ে তুলেছেন।বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় নগর সভ্যতার আগ্রসনে সবুজ বনাঞ্চলের ধ্বংস হয়ে যাওয়ার বেদনায় ‘আরণ্যক’ উপন্যাসে-নির্জন মায়াবী অরণ্যের বর্ণনা, সেখানকার হতদরিদ্র মানুষের জীবন সংগ্রাম, তাদের আনন্দ-উচ্ছ্বাস-অভাব-আবেগকে প্রগাঢ় জীবন দর্শনের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন।কাজী নজরুল ইসলামকে কবি হিসেবেই সবাই চেনে। কিন্তু কবি নজরুলের বিকাশ ঘটেছে কথাসাহিত্য দিয়েই।নজরুলের ‘মৃত্যুক্ষুধা’ উপন্যাসটি বাংলা সাহিত্যের প্রথম সাম্যবাদী চেতনার উপন্যাস।উপন্যাসটি নজরুলের বাস্তব অভিজ্ঞতাপ্রসূত।মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’ মৃত্যুচেতন জীবনময়তার উপন্যাস।বাংলা উপন্যাসের ধারায় পুতুলনাচের ইতিকথাই প্রথম গ্রন্থ, যেখানে ফ্রয়েডীয় অবচেতন মনের 'প্রথম সার্থক চিত্রায়ণ' ঘটেছে।আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘চিলেকোঠার সেপাই' বিক্ষুব্ধ কালের এক মহাকাব্যিক আখ্যান।এই উপন্যাসের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পূর্ববর্তী রূপটি ফুটে উঠেছে।হাসান আজিজুল হকের ‘আগুনপাখি’ উপন্যাসটি দেশভাগের পটভূমিতে রচিত ব্যথিত উপাখ্যান।উপন্যাসটি একটি গ্রামীণ পরিবারের উত্থান-পতনের ইতিহাস তুলে ধরেছে। ভারত বিভাগের কয়েক বছর আগে থেকে এর কাহিনি শুরু হয়। উপন্যাসটি একজন গ্রামীণ গৃহিণীর দৃষ্টিকোণ থেকে, উত্তম পুরুষে লিখিত।বাংলা সাহিত্যের ব্যতিক্রমী লেখক মানুষের কথাকার আব্দুল জব্বারের নদীমাতৃক বাদা অঞ্চলের মানুষের বাস্তব আখ্যান ‘ইলিশমারী চর’ উপন্যাস।উপন্যাসে জেলে-মাঝিদের জীবনের নিখুঁত ছবি উপস্থাপিত।ঐ সম্প্রদায় কেমনভাবে নিজেদের পেশাকে অবলম্বন করে জীবনযাপন করে তা নিয়ে বাস্তবঘনিষ্ঠতার স্বাদে এ উপন্যাস সম্পৃক্ত।কবি জীবনানন্দ দাশের আত্মজৈবনিক আখ্যান ‘মাল্যবান’ উপন্যাস। এই উপন্যাসে প্রচ্ছন্নভাবে রয়েছে তাঁর যাপিত জীবনের চালচিত্র ও সংকট।জীবনানন্দ জীবনীকার ক্লিংটন বি সিলি লিখেছেন, ‘মধ্যশ্রেণীর ও মধ্যবয়সী বাঙালি দম্পত্তির স্টাডি হলো ‘মাল্যবান’।তপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের “নদী মাটি অরণ্য” সুন্দরবন নামক মূল ভূখণ্ডের জনজীবন থেকে নির্বাসিত-বিতাড়িত-ছিন্নমূল মানুষের নদীভিত্তিক আঞ্চলিক ইতিহাস আশ্রয়ী মহাকাব্যিক উপন্যাস।মানুষের জীবনে নদী কখনো বন্ধু, কখনো ভয়ঙ্কর প্রতিপক্ষ ও ধ্বংসকারী। নদীকে এড়িয়ে মানুষের জীবন গড়া ও সভ্যতার ঐশ্বর্য নির্মাণ অকল্পনীয়। নদীভিত্তিক উপন্যাসে এ সত্য নানাভাবে উপস্থাপিত হয়েছে।অভিজিৎ সেনের ‘রহু চণ্ডালের হাড়’ উপন্যাস উপেক্ষিত বাজিকর যাযাবর জাতির আখ্যান,লোকজীবনের ইতিহাস।অজানা অস্পষ্ট ধর্মের ধারক ও বাহক এক প্রান্তিক যাযাবর জনগোষ্ঠী এই উপন্যাসের প্রধান কুশীলব।চৈতন্য প্রবাহ রীতিতে লিখিতমজিদ মাহমুদের “মেমোরিয়াল ক্লাব” উপন্যাস স্বাধীনোত্তর বাংলাদেশের অর্ধশতাব্দীর আর্থ-সামাজিক বাস্তব যাপন চিত্র।এই উপন্যাসটি চেনা ছকের বাইরে উত্তরাধুনিক স্টাইলে লেখা একই সঙ্গে সামাজিক ও রাজনৈতিক উপন্যাস।লেখক একটি নতুন গড়ে ওঠা দেশের গ্রামীণ জীবন থেকে নাগরিক জীবনে ধারাবাহিকভাবে বদলে যাওয়ার চালচিত্র অত্যন্ত বলিষ্ঠতা এবং বিশ্বাসযোগ্যতার সঙ্গে এই উপন্যাসে তুলে ধরতে সফল হয়েছেন।‘উত্তরাধুনিক বাংলা উপন্যাস কালের মহাকাব্যিক আখ্যান’ গ্রন্থের নির্বাচিত পনেরটি উপন্যাস মহাকাব্যিক আখ্যানে লিখিত কালের মানবিক ইতিহাস। যা পাঠককে উত্তরাধুনিক উপন্যাস সম্পর্কে একটি স্পষ্ট ধারণা দেবে। সেই সঙ্গে পাঠকের মনন ও মেধাকে সমৃদ্ধ করবে বলে আমি নিশ্চিতভাবে আশাবাদী।