এক
তুমুল হৈচৈ আর ক্যামেরার ফ্ল্যাশের বন্যা বয়ে চলছে। প্রেস কনফারেন্সের এ এক সাধারণ দৃশ্য। কিন্তু আজকের সবকিছুই যেন এককাঠি চড়ে গিয়েছে বাড়তি উত্তেজনায়। চলচ্চিত্র পরিচালক জাভেদ শিকদারের হালে মুক্তিপ্রাপ্ত বিতর্কিত এক ছবি এখন সবার আলোচনার বিষয়বস্তু।
সকলের মধ্যমণিটি স্টেজে বসে ভাবলেশহীনভাবে একে একে উত্তর দিয়ে চলেছেন। পাশে বসে আছেন ছবির নায়ক-নায়িকা, প্রডিউসাররা। জাভেদ শিকদারের ওপর সকল প্রশ্নের ভার দিয়ে তারা চেহারায় মুখোশের হাসি নিয়ে বসে আছেন; যেমন সবসময় থাকেন, যেমন থাকতে হয়!
‘স্যার, এত বিতর্কিত নারীচরিত্র তৈরি করার পেছনে আপনার কী মনোভাব কাজ করছিল?’
‘স্যার, সবাই বলছে আপনি নারীবিদ্বেষী, সরংড়মুহরংঃ., এ ব্যাপারে আপনার কী মত?’
সাংবাদিকদের প্রশ্ন শুনে জাভেদ শিকদার মৃদু হাসেন।
‘আমারো একটা প্রশ্ন আছে। একটু চিন্তা করে দেখুন তো, এই চরিত্রটা নিয়ে এত প্রশ্ন উঠছে কেন? শুধু নারীচরিত্র বলেই নয় কি? এটা যদি একটা পুরুষচরিত্র হতো, তাহলেও কি আপনাদের এত খারাপ লাগতো?’
পরিচালকের পালটা প্রশ্নের মাঝে জবাব খুঁজে নেন সাংবাদিকরা। তবুও তারা দমে যাবার পাত্র নন। প্রশ্ন আর কৌতূহলের তোড় বেড়ে যায়।
‘স্যার, আপনি নিজেকে নারীবিদ্বেষী দাবি না করলেও আপনার ছবিতে মেয়েদের জীবনের যুদ্ধগুলোকে পরোক্ষভাবে ব্যঙ্গ করা হয়েছে। এটা একটা জেন্ডার বায়াস্ড্, অর্থাৎ লিঙ্গ পক্ষপাতমূলক ছবি নয় কি?’
জাভেদ সাহেবের সপ্রভিত চেহারায় এবার স্মিত কৌতুক দেখা যায়। তার কথার মাঝেও কৌতুক লক্ষ করা যায়।
“আমরা সবাই আসলে জেন্ডার বায়াস্ড্। মেয়েদের মেয়ে বলে ‘হেয়’ করাটা সরংড়মুহরংস. কিন্তু মেয়েদের মেয়ে বলে ভালো হিসেবে দেখাটাও একধরনের পক্ষপাতিত্ব। মেয়েরাও মানুষ যদি হয়, মেয়েরাও অমানুষ। হা হা। এটা পুরুষচরিত্র হলে আমাকে কি আপনারা পুরুষবিদ্বেষী বলতেন?”
“স্যার, ‘মেয়েরাও অমানুষ’ এমন কথা আজ পর্যন্ত কাউকে বলতে শোনা যায়নি। আপনি কি ইচ্ছা করে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হবার জন্য এমন চরিত্রের অবতারণা করেছেন?”
‘এ ধরনের ব্যতিক্রমী চরিত্রের আইডিয়া কোথা থেকে পেলেন, ব্যক্তিগত কোনো তিক্ত অভিজ্ঞতা আছে কি?’
‘হ্যাঁ, এটা কি ব্যক্তিগত তিক্ত অভিজ্ঞতার ফল? নাকি এটা কোনো প্রমোশনাল স্ট্র্যাটেজি?’
জাভেদ শিকদার আবার হাসেন আর বলেন,
‘এত টাকা খরচ করে সিনেমা বয়কট করার মতো প্রমোশনের স্ট্র্যাটেজি কেউ করে? আর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলছেন? আমার পরিবার বলতে তো মা, স্ত্রী আর মেয়ে। তিনজন নারীকে নিয়ে বাস। যাদের অবদান জীবনে অনস্বীকার্য রে ভাই।’
স্টেজে বসা হাস্যরত মুখোশগুলো ভেতরে ভেতরে ঘামে। নায়ক-নায়িকা একে অপরের চোখাচোখি হয়। আপাতদৃষ্টিতে মুখোশের হাসির পরিবর্তন হয় না। কিন্তু নায়িকা ফ্লোরার মনে হয়, নায়ক যেন একটু ঢোক গিলল। বেচারা নতুন আমদানি। নায়ক হলেও, তার ভূমিকা তেমন নেই বললেই চলে। ‘নায়িকা-প্রধান’ গল্পে তার চরিত্র ম্রিয়মাণ। তবুও জাভেদ শিকদারের সাথে কাজ করতে কে না চায়! ফ্লোরা নিজেও কি চায় না? তার গ্ল্যামারের ইতিহাস শুরু হয়েছে জাভেদ শিকদারের হাত ধরে। স্যারের ওপর ভরসা করলেও প্রমোশনের আগের এই অস্থিরতা বরাবর ভোগায়। বিশেষ করে জাভেদ শিকদারের সাথে কাজ করা মানে তো রীতিমতো রটনার তুঙ্গে উঠে যাওয়া।
‘মেয়েরাও অমানুষ’Ñ এ উক্তি বহুদূর গড়াবে বলে মনে হয় ফ্লোরার। আগামীকাল এ নিয়ে টক-শো হবে, তর্ক-বিতর্ক চলবে। সবচেয়ে বড়ো কথা, পেপারে ওর কত কিসিমের কার্টুন বের হবে সে কথা চিন্তা করে মনের অজান্তে হাসিটা ‘একান ওকান’ থেকে খানিক সরে আসে ফ্লোরার। ঠিক তখনই জাভেদ স্যারের সাথে চোখের আদান-প্রদানে আবার মুখোশ আগের জায়গায় বসে যায়।
এই মানুষটার সাথে কাজ করার আকর্ষণই আলাদা। এক অদ্ভুত দ্যুতি চলে আসে জীবনে। জীবনকে মনে হয় অর্থবহ। স্ক্রিপ্ট বোঝানোর সময়গুলো হয় সবচেয়ে রঙিন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা শুনে যেতে পারে ফ্লোরা, কোনো ক্লান্তি নেই! কাজগুলো হয় পৃথিবীর সবচেয়ে আনন্দের খেলা। খেলাগুলো যেন নেশা!
এই নেশা কি সেই চিরাচরিত সর্বনাশা নেশা? এই আকর্ষণ কি ঠিক নারী-পুরুষের জৈবিক আকর্ষণ? ফ্লোরা অনেক ভেবেছে এ ব্যাপারে। এটা অনেকটা যেন বিগ্রহের প্রতি ভক্তের আকর্ষণের মতো। একটু কৃপাদৃষ্টি পেলে হৃদয়টা কচি খুকির মতো ধড়ফড়িয়ে ওঠে উৎসাহে। এর বেশি কিছু পাবার নেই বলে হয়তো আশাও নেই। আশাহত হবারও কিছু নেই। কিন্তু আশাহত হবার নেই কেন ভাবছে! মুভি শেষ হবার দিনটা বরাবর খুব খারাপ কাটে। কোনোমতে কান্না আটকে রাখতে হয়। এই নিয়ে কয়েকটা মুভিতে কাজ করেছে জাভেদ স্যারের সাথে। প্রতিবার কাজ শেষ করার পর মানুষটার আমূল পরিবর্তন হয়। যেন ফ্লোরা অনেক দূরের কোনো আত্মীয়, ক্ষণিকের জন্য এসেছিল, অনেক আদর আপ্যায়ন করা হয়েছে, এখন বিদায়ের পালা। বিদায় শেষে গৃহস্থ যেমন দরজা পেছনে বন্ধ করে দেন, জাভেদ শিকদারের মনের দরজাও ঠিক সেভাবে বন্ধ হয়ে যায়। হয়তো এটাই পেশাগত নীতি।
ওদিকে ফ্লোরার মনে আবার নতুন করে অপেক্ষার প্রহর শুরু হয়। আবার কি ডাক আসবে? হেলাল হাফিজের কবিতার মতোÑ
’কোনোদিন আচমকা একদিন, ভালবাসা এসে যদি হুট করে বলে বসে,
‘চলো’, যেদিকে দুচোখ যায় চলো যাই, যাবে?’
“ভালোবাসা! সেকি ! ভালোবাসা কেন ভাবছে! এটা কি ভালোবাসা? নাহ্! তা কী করে হয়?”
‘ফ্লোরা ম্যাডাম? আপনার এবারের অভিজ্ঞতা কেমন হলো?’
ফ্লোরার চিন্তার ঘোর ভাঙে সাংবাদিকের প্রশ্নে। একটু চমকে ওঠে। কিন্তু সামলে নেয়।
‘জাভেদ স্যারের সাথে তিন-তিনটা মুভিতে কাজ করেছেন ম্যাডাম। এই মুভির অভিজ্ঞতা কেমন হলো একটু বলুন।’
‘ম্যাডাম, একজন নারী হয়ে বিতর্কিত নারীচরিত্রে অভিনয় করতে স্যারের সাথে মতভেদ হয়েছে কি?’
‘জাভেদ স্যারের মতো আপনিও কি মনে করেন মেয়েরাও অমানুষ?’
ফ্লোরা হাসিমুখে উত্তর দেয়,
‘আপনারা যেসব প্রশ্ন করছেন, সে প্রশ্নগুলো আমিও করেছিলাম জাভেদ স্যারকে। উত্তরগুলো উনি সাথে সাথে দেননি। মুভি শেষ করার পর আমার যেটা মনে হয়েছে, আমাদের জীবন কোনো রূপকথা নয়Ñ যেখানে গল্পের শেষে খুব ভালো কোনো মসিহা খুব খারাপ কোনো দৈত্যকে মেরে সমাধান নিয়ে আসবে। মানুষের জীবন, চরিত্র ও পারিপার্শ্বিকতা কোনো কিছুই ঠিক সাদা-কালো নয়। তাই কোনো প্রশ্নের উত্তরই হ্যাঁ-না বলে দেওয়া সম্ভব নয়।
যে কথাটুকু বললাম, এই কথাটুকু বুঝতে আমাকে স্ক্রিপ্ট পড়তে হয়েছে, চরিত্র বুঝতে হয়েছে, সংলাপ মনে রেখে অভিনয় করতে হয়েছে। আপনারা শুধু ট্রেইলার দেখে প্রশ্ন করতে ছুটে এসেছেন। আমার তো মনে হয় এই মুভি একবার দেখার মুভি না। একবার দেখুন, দুবার দেখুন, বারবার দেখুন। আমার বিশ্বাস, আপনাদের জীবনে এই ফিল্ম একটা নতুন দৃষ্টিভঙ্গি বা নতুন অর্থ বয়ে নিয়ে আসবে।’
ফ্লোরার উত্তরের পর আরো একঝাঁক প্রশ্ন ছুটে আসে, আরো কিছু ফ্ল্যাশের চমক ছোটে।
ফ্লোরা নিজের উত্তরের বৈধতা খোঁজে যার কাছে, তার ওপর একটুখানি নজর ঘুরে আসে। দেখে তাঁর চাহনিতে বিরল এক মুহূর্তের প্রশংসা। সে এক অপূর্ব অনুভূতি!
নায়িকা ফ্লোরা। ভালো নাম ফরিদা পারভিন। আসল বয়স একত্রিশ, সার্টিফিকেটের বয়স ঊনত্রিশ আর পাবলিককে বলার বয়স ছাব্বিশ। বাবা ফজলুর রহমান একজন ব্যাংকার। মা সিনিয়র হেলথ অফিসার। তিন বোনের মধ্যে সবচেয়ে বড়ো সে। ফজলুর রহমান সাহেব তার বড়ো মেয়েকে নিজের নামের আদ্যক্ষরে নাম রাখতে গিয়ে জনপ্রিয় গায়িকার নাম দিয়েছেন। এই নিয়ে মেয়ের বড়ো আপত্তি। আপত্তি থেকে বিপ্লবী হয়ে গায়িকা না হয়ে নায়িকা হয়েছে সে। নিজের নাম ফরিদা পালটে রেখেছে ফ্লোরা।
নামটা তার জন্য পয়া বলে প্রমাণ হয়েছে। কিন্তু বাবা মায়ের মন মানতে রাজি নয়। অসুখবিসুখ হলেই নতুন নামের দোষ দেন। একদিন ফ্লোরাকে না জানিয়ে গোপনে খাসি কোরবানি দিয়ে মেয়ের আবার আকিকা করেছেন তারা। আজকাল তারাও মেয়ের তালে তাল মিলিয়ে বলেন যে, নামটা বেশ পয়া।
মধ্যবিত্ত মুসলমান পরিবারের মেয়ের সিনেমা করা নিয়ে হয়তো আপত্তি উঠতো, কিন্তু যে হারে পয়সার অন্তর্বাহ শুরু হলো, তাতে আপত্তি ধীরে ধীরে উপায় হয়ে উঠলো অনেক ছোটো-বড়ো দৈনন্দিন যাপনের। ছোটো দুই মেয়ের পড়াশুনা আর বিয়ের চিন্তা অনায়াসে গায়েব হয়ে গেল। তবুও বাপের মনে বড়ো মেয়ের একটা ব্যাপার খোঁচা দেয়। মেয়েটা আর একটা বছর পড়তে পারলে ব্যাচেলরটা শেষ করতে পারতো।
মায়ের চিন্তা আবার বিয়ে নিয়ে। ফ্লোরা বাবাকে বলেছে সুযোগ পেলেই আবার কলেজে ফেরত গিয়ে গ্র্যজুয়েট হয়ে যাবে। আর মাকে বলেছে সুন্দর দেখে কোনো এক নায়ককে ঠিক একদিন বিয়ে করে নেবে। বাবা মাকে এসব বলে বুঝিয়েসুঝিয়ে রেখেছে সে। কিন্তু নিজের মনের গতিক আজকাল ভালো ঠেকছে না ফ্লোরার। বিশেষ একজনের ডাকের অপেক্ষায় কান পেতে থাকে। আবার যে কবে সে ডাকবে! কোনো একদিন মোবাইলের ওপার থেকে জলদ গম্ভীর কণ্ঠস্বরে বলবে, ‘ফ্লোরা!’
‘ফ্লোরা!...ফ্লোরাআআ!’
‘ওহ!! হ্যাঁ !! জ্বী ?’
সেই জলদ গম্ভীর কণ্ঠস্বর ডাকছে! আজকেই? বিদায়ের জন্য? ভালো উত্তরের বাহবা? নাকি অন্য কিছু? অন্য কী কারণ হতে পারে? ফ্লোরা এক হাত পেছনে নিয়ে ‘ফিঙ্গার ক্রস’ করে।
প্রার্থনার নতুন এক ফ্যাশন এই ‘ফিঙ্গার ক্রস’। তর্জনী মধ্যমার জড়াজড়ি। আগে জানত না।
ফ্লোরা জাভেদ শিকদারের কাছে এগিয়ে আসে। উনি অন্য একজনের সাথে কথা শেষ করছেন, তাই একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকে ফ্লোরা। তারপর হাতের ইশারা পেয়ে কাছে যায় আরেকটু।
‘শোনো ফ্লোরা, তোমার সাথে কথা আছে। তুমি এক কাজ করো, লাঞ্চ সেরে নাও। না, তুমি আজকে আমার সাথে লাঞ্চ করবে। দাঁড়াও, আমি শোয়েবকে বলে দিচ্ছি, তোমাকে আমার অফিসে নামিয়ে দেবে। ওখানে আমার টেবিলের ওপর কমল চিত্তরঞ্জনের লেখা নতুন একটা বই পাবে। সেটা পড়তে শুরু করো, ওকে?”
গাড়িতে বসে ফ্লোরার মন খুশিতে নাচে। নতুন বই পড়তে হবে, তার মানে নতুন সিনেমা। এবার আর প্রতীক্ষার প্রহর গোনা নয়! লাঞ্চ পর্যন্ত এই কিছু সময়ের অপেক্ষা শুধু!
ফ্লোরার মন নাচে আর একই গাড়িতে বসে শোয়েবের মন উচাটন হয়। কারো পৌষ মাস, কারো সর্বনাশ যাকে বলে! এই তো জীবন।
গাড়ির সামনের প্যাসেঞ্জার সিটে বসে আছে জাভেদ শিকদারের সেক্রেটারি কাম ম্যানেজার শোয়েবুল্লাহ। শোয়েবুল্লাহ ভেবেছিল আজকে ছুটির দরখাস্ত করবে। কিন্তু ইতোমধ্যে নতুন ছবির জোগাড়যন্ত্র শুরু করতে হচ্ছে। জাভেদ স্যারকে কি পরিবারকে সময় দেওয়ার দরকার হয় না? মাঝে মাঝে ভেবে অবাক আর বিরক্ত হয় শোয়েব। এত কাজ কেউ করতে পারে? নিজের ছুটি লাগে না বলে কি অন্য কারোর ছুটির দরকার নেই?
সবকিছু ছাপিয়ে সবচেয়ে বিরক্তি লাগে এই কথা ভেবে যে, আজকে লেখক চিত্তরঞ্জন বাবুর সাথে যোগাযোগ করতে হবে। সমস্যা হচ্ছে, এই ভদ্রলোক নিজে দেখা করেন না। তার কোনো এজেন্ট নেই। এমন মান্ধাতার আমলের লোকÑ যার একটা ইমেইল পর্যন্ত নেই। থাকার মধ্যে আছে শুধু এক প্রকাশক, যার আঠারো মাসে বছর হয়। কিছু কিছু মানুষ আছে, যাদের টাকা দিয়েও খাটানো যায় না। শোয়েবের দুর্ভাগ্য, এই প্রকাশক মশাই তেমনই এক মানুষ!
দীর্ঘশ্বাস ফেলে সামনের সিট থেকে মাথা একটু ঘোরায় শোয়েব, তবে পুরোটা নয়। সহবত বজায় রেখে ফ্লোরার উদ্দেশে বলে,
‘ম্যাডাম, লাঞ্চে কী অর্ডার করব?’
‘স্যারের জন্য কী অর্ডার করছেন?’
‘স্যার এখনো জানায়নি ম্যাম!’
‘তাহলে বরং অপেক্ষা করি। একসাথেই অর্ডার করব।’
মনে মনে শোয়েবের প্রশংসা করে ফ্লোরা। খাবারের কথা জিজ্ঞেস করার জন্য নয়। শোয়েবের সবকিছু ম্যানেজ করার দক্ষতা অসাধারণ। কিন্তু যে গুণটার জন্য মনে মনে শোয়েবের প্রশংসা করছে ফ্লোরা সেটা হচ্ছে, ওর বডি ল্যাংগুয়েজ। বড়ো বড়ো মানুষদের ড্রাইভার, সেক্রেটারি, ম্যানেজাররা বেশ ত্যাঁদড় হয়। এদের হাবভাব মালিকদের চেয়েও এককাঠি বড়ো থাকে। কিন্তু শোয়েব লোকটা বেশ ভদ্র। ফ্লোরা ভাবে, এরকম একটা সেক্রেটারি কাম ম্যানেজার ওরও দরকার। কিন্তু নিজের মাতব্বর মেঝ বোনকে কাজ থেকে হটাবে কী করে? ডিগ্রি পাস করে বেরিয়ে এখন বাড়ির জ্ঞানী সদস্য হয়ে বসে আছে। চাকরি করছে বোনের, খাচ্ছে বাপের, থাকছে দাদার বানানো বাড়িতে, অথচ ভাবটা এমন যেন পৃথিবীতে এসে সবাইকে সে ধন্য করে দিয়েছে। ফ্লোরা একটু বিরক্ত হয়, কিন্তু সে বিরক্তি কাটতে দেরি হয় না। আজকের দিনটা ঝলোমলো মনের দিন হওয়ার কথা। কাজেই, ‘ফুল ফুটুক না ফুটুক, আজ বসন্ত!’
ফ্লোরা অফিসে পৌঁছে বাধ্য মেয়ের মতো বইটা পড়তে শুরু করে।
কিছু সময় বাদে, জানে না ঠিক কত সময় পর, দরজায় টোকা পড়ে। ফ্লোরা উৎসুক হয়ে তাকায়। কিন্তু আশাহত হয়। শোয়েব আর তার দলবল খাবারের ট্রে নিয়ে এসেছে। জানা গেল, স্যারের আসতে দেরি হচ্ছে তাই খাবার পাঠিয়েছেন, সাথে একটা ফুলের তোড়া। দেরি করার জন্য ‘অ্যাপোলোজি’ স্বরূপ।
মনটা দমে যেত হয়তো। কিন্তু ফুলগুলো শুধু এই মুহূর্তের নয়, সাত জনমের দুঃখ ভোলায়। ঠোঁটের কোনায় হাসি নিয়ে প্লেটে খাবার তুলে নেয় ফ্লোরা। একটা ব্যাপার খেয়াল করে আজ। জাভেদ শিকদারের ম্যানেজার থেকে শুরু করে কাজের লোক, কোথাও কোনো মহিলা এমপ্লয়ী নেই। উনি কি আসলেই নারীবিদ্বেষী? কিন্তু তা কী করে সম্ভব? কথাগুলো একটু সময় ভাবায়। ফ্লোরা মাথা থেকে চিন্তা ঝেড়ে এক হাতে চামচে খাবার তুলে নেয়, আরেক হাতে বই নিয়ে পড়তে থাকে।
দুই
‘আপনাদের জাভেদ স্যার অফিসে আছে?’
শোয়েব বিরস মুখে ফোনে মাথা গুঁজে বিশিষ্ট অলস প্রকাশকের ম্যানেজারের নাম্বার খুঁজছিল। তাই প্রশ্নকারীকে খেয়াল করেনি। মোবাইল থেকে মুখ না তুলেই বলে,
‘স্যার এখন জরুরি মিটিংয়ে ব্যস্ত। আপনার অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে?’ একথা বলে মাথা তোলার সাথে সাথে চোয়াল ঝুলে পড়ে শোয়েবের। ‘সরি’ ‘সরি’ বলতে বলতে মুখের ফেনা তুলে ফেলে প্রায়।
এমন ভুল শোয়েব সাধারণত করে না। তবে দুপুরের ব্যস্ত সময়ে পেটে ক্ষুধা নিয়ে মাথা ঠিক থাকে না। নিজের বিবেচনা হারিয়ে ফেলেছিল শোয়েব। নাহলে কোলাহল ছাপিয়ে প্রশ্নটার ধরন শুনে বুঝতে পারতো যে জাভেদ শিকদারকে ‘আপনাদের জাভেদ স্যার’ বলার মতো মানুষ খুব কমই আছে।
শোয়েব তড়িঘড়ি ইন্টারকমের ক্রেডেল তুলে নেয়।
ফ্লোরার খাওয়া প্রায় শেষ হয়ে এসেছিল যখন জাভেদ স্যার এলেন। ও বিব্রত হয়। একটু অপেক্ষা করতে পারতো ভেবে আফসোস হয়। যেটুকু প্লেটে আছে, তা বাঁচিয়ে রাখে একসাথে খাবার জন্য। তখনই ইন্টারকম বেজে ওঠে। ফ্লোরা ইতস্তত একবার ফোনের দিকে, আর একবার ওয়াশ রুমের দিকে তাকায়। স্যার ওয়াশরুমে আছেনÑ একথা কি জানানো উচিত? ফোন তোলাটা কি শোভন হবে?
ফ্লোরাকে অপেক্ষা করতে হয় না। জাভেদ সাহেব হাত-মুখ মুছতে মুছতে বের হন, আর ইন্টারকমের স্পিকার টিপে দেন। শোয়েবের হড়বড়ে করে বলা খসখসে আওয়াজ ভেসে আসে,
‘স্যার, ম্যাডাম এসেছেন।’
‘কোন ম্যাডাম?’ (জাভেদের ভ্রুতে ভাঁজ পড়ে)
‘আমাদের ম্যাডাম, মানে আপনার ওয়াইফ, স্যার।’
খসখসে ইন্টারকমে শোয়েবের কথা শুনে ফ্লোরার হৃদয়টা লাফিয়ে ওঠে। এই প্রথম জাভেদ স্যারের ওয়াইফের সাথে দেখা হবে। এই ক’বছরে কখনও দেখা হয়নি। জাভেদ স্যার নিজের পরিবারকে নিয়ে কখনও কোনো কথা বলেন না। উনি কাজ আর পরিবারকে আলাদা রেখেছেন সবসময়। আজকে প্রেস কনফারেন্সে প্রথম বললেন যে তিন নারী নিয়ে তার বাস। বেশ কাকতালীয় ব্যাপার বলতে হয়।
ভদ্রমহিলা দরজায় উদয় হলেন। ‘উদয়’ শব্দটা একেবারে ঠিক মিলে যায়, কারণ চন্দ্র সূর্য উদয়ের মতো মনে হলো ঘরটা আলোকিত হয়ে গেল। ধবধবে সাদা সুতির শাড়ি পরে এসেছেন। দুপুরের রোদে শান্তি ছড়ানোর মতো। পুরো শাড়িতে অ্যাপ্লিকের ফুল বসানো। ফুলের একেক পাপড়ি একেক রঙের। আলোর মাঝে যেন টুকরো টুকরো রংধনু।
ফ্লোরা উঠে দাঁড়িয়ে সালাম দিলে উনি মৃদু স্বরে সালামের উত্তর দেন।
ওদের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে তেমনই মৃদু স্বরে স্বল্প শব্দের কথোপকথন চলে। ফ্লোরা বেশিরভাগ কথা আন্দাজ করে নেয়।
জাভেদ স্যার স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেন, ‘মা?’ (অর্থাৎ মায়ের কিছু হয়েছে?)
‘মা ঠিক আছে।’
‘জাইমা?’ (হয়তো মেয়ের নাম। মানে, মেয়ে ভালো আছে কি না জিজ্ঞেস করছেন।)
মাথা এদিক ওদিক নাড়েন মহিলা। (এর অর্থ ‘হ্যাঁ’-‘না’ দুটোই হতে পারে।)
জাভেদ স্যারের স্ত্রী কথা শুরু করেন, ‘আমার একটা জরুরি কথা ছিল, আসলে একটা ছেলে...’
(স্যারের তর্জনী আর মধ্যমা হালকা উঠতে দেখে থেমে যান তার স্ত্রী।)
‘তুমি খেয়েছো?’ (স্যারের প্রশ্ন)
‘না।’
‘চলো, খাই।’
ভদ্রমহিলাকে দ্বিধা নিয়ে টেবিলের দিকে তাকাতে দেখে ফ্লোরা। আবার বিব্রত বোধ করে।
জাভেদ স্যারের তেমন কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। পকেট থেকে চাবি বের করে টেবিলের ড্রয়ারের তালা খুলে একটা বড়ো খাম বের করেন উনি। তারপর টেবিল থেকে মোবাইল তুলে নিয়ে দরজার কাছে গিয়ে দরজা খুলে ধরেন। (অর্থাৎ তারা বাইরে খাবেন)।
জাভেদ স্যার ফ্লোরার দিকে তাকিয়ে বলেন,
‘আই অ্যাম সরি, ফ্লোরা। তুমি খাবার শেষ করো, আর যতটুকু পারো বইটা পড়ে যাও। বইটা নিয়ে যেও না। ওতে আমার নোট্স্ আছে।’