আমাদের ভ্রমণের অভ্যাস আছে। বছরে কয়েকবার ভ্রমণ করি। বন্ধুরা মিলে আমরা যখন দূরে কোথাও ভ্রমণে যাই, তখন আমাদের আড্ডা হয়। তুমুল আড্ডা। আড্ডায় বলি নানা গল্প। তবে শর্ত থাকে। কোনো গল্প পাঁচ মিনিটের বেশি বলা যাবে না। ফলে প্রত্যেককে পাঁচ বা সাত মিনিটের মধ্যে গল্প শেষ করতে হয়। এই স্বল্প সময়ে গল্প শেষ করার শর্তের কারণ, শ্রোতাদের মধ্যে যেন বিরক্তির উদ্রেক না ঘটে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আমরা যেসব গল্প বলি বা শুনি, সেগুলোকে যদি লেখ্যরূপ দেওয়া হয়, তবে একেকটি অণুগল্প হয়ে যাবে।
ভ্রমণে গেলে অণুগল্প বলা বা শোনার অভিজ্ঞতা কেবল আমার বা আমাদের নয়, আপনাদেরও আছে নিশ্চয়ই। থাকারই কথা। ভ্রমণ মানেই তো আড্ডা, ভ্রমণ মানেই তো কথা। আর কথা মানেই গল্প। গল্প ছাড়া ভ্রমণ পূর্ণতা পায় না, সার্থক হয়ে ওঠে না। সেসব গল্প অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হয় অণুর পরিমাণ। ছোটগল্পের অর্ধেক বা অর্ধেকেরও অর্ধেক। এই ধারার গল্পকেই বলা হয় অণুগল্প। এই অণুগল্প বলা বা শোনার চর্চা আমাদের মধ্যে আছে। কিন্তু লেখার চর্চাটা খুব একটা আছে, এটা বলা যাবে না। বাংলাদেশে যাঁরা প্রতিষ্ঠিত কিংবা প্রায়-প্রতিষ্ঠিত কথাসাহিত্যিক, তাঁরা সাধারণত অণুগল্প চর্চা করেন না। বাংলাদেশের গত শতকের কথাসাহিত্যিকদের কোনো অণুগল্পের বই নেই। থাকলেও আমার পড়া নেই। বর্তমান শতকের দ্বিতীয় ও তৃতীয় দশকের অনেক কথাসাহিত্যিক অনুগল্প লিখেছেন, লিখছেন। কারও কারও বইও হয়েছে।
কবিতার মধ্য দিয়ে মাহফুজ রিপন ইতিমধ্যেই পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছেন। কবিতায় তার নিবেদন আমাদেরও চোখ এড়ায় না। পাশাপাশি তার গল্পকার পরিচয়ও গৌণ করে দেখার উপায় নেই। ছোটগল্পেও তিনি রেখেছেন প্রতিভার পরিচয়। তার গল্প পড়লে বোঝা যায় তিনি সাহিত্য করতে এসেছেন এবং সাহিত্যের প্রতি নতজানু থেকে নিরলসভাবে সাহিত্যসৃষ্টি করে চলেছেন।
এবার তার যাত্রা সাহিত্যের অন্য এক দিগন্তে, অণুগল্পে। কবিতা ও ছোটগল্পে সাফল্যের পর সাহিত্যের অবিকশিত এই শাখায় তিনি কতটা যশ লাভ করবেন, তা এখুনি বলা কঠিন। এর কারণ বহুবিধ। প্রধান কারণটি হচ্ছে, সাহিত্যের শাখাসমূহের মধ্যে অণুগল্পের পাঠকের সংখ্যা বাংলাদেশে এখনো কম। এই শাখাটির প্রতি পাঠকদের আগ্রহ এখনো ব্যাপকভাবে তৈরি হয়নি। কবিতা, ছোটগল্প বা উপন্যাসকে পাঠক যেভাবে গ্রহণ করে, অণুগল্পকে সেভাবে করে না। সেই জায়গা থেকে মাহফুজ রিপন একটা ঝুঁকিই নিলেন। আশা করি তিনি এই ঝুঁকি উতরাতে সক্ষম হবেন।
ছত্রিশটি গল্প নিয়ে মাহফুজ রিপনের বই অণুগল্পের ঘোড়া। গল্পগুলো পড়ার পর আপনার মনে হবে গল্পকার কিছু বলতে চেয়েছেন। প্রত্যেক গল্পকারই কিছু বলতে চান বলেই গল্প লেখেন। সেই বলাটা গল্পে সরাসরি বলা হয় না। বলা হয় একটু ঘুরিয়ে, একটু বাঁকাভাবে, একটু ত্যারচাভাবে। সেই বলার মধ্যে ধোঁয়াশা থাকে, ধাঁধা থাকে। অর্থাৎ গল্পকার তার গল্পের শরীরে কুয়াশা ছড়িয়ে দেন। সেই কুয়াশা সরিয়ে পাঠককে আবিষ্কার করে নিতে হয় গল্পের শাঁস বা সারভাগ।