এই গ্রন্থে যার প্রবন্ধ সংকলিত হয়েছে তাঁর লেখার সাথে আমার পরিচয় ঘটে ১৯৭২ সালে। মহসিন শস্ত্রপাণি তখন ফিচার লিখতেন অধুনালুপ্ত দৈনিক আজাদ পত্রিকায়। তাঁর প্রবন্ধের বিশেষত্ব হলো তিনি গুছিয়ে লিখতেন। তিনি যা লিখতেন তা ছিলো যুক্তিগ্রাহ্য। তিনি যা বলতে চাইতেন তা যুক্তি সহকারে গুছিয়ে লিখতেন। অন্যের বোঝার উপযোগী ভাষা তিনি ব্যবহার করতেন। তিনি বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় অসংখ্য প্রবন্ধ লিখেছেন। সেগুলোর সব এই গ্রন্থে সন্নিবেশিত করা সম্ভব হয়নি।
মহসিন শস্ত্রপাণি আদর্শিকভাবে মার্কসীয় মতাদর্শে বিশ্বাস করতেন। তিনি সমাজ পরিবর্তনের ধারায় বিশ্বাসী ছিলেন এবং তাঁর লেখায় এটা তিনি ফুটিয়ে তুলতেন।
তিনি মনে করতেন কোনো লেখক নিরপেক্ষ হতে পারেন না। তিনি যা লিখবেন তাতে তার মতামত প্রতিফলিত হতে বাধ্য। হয় তিনি হবেন প্রগতিশীল অর্থাৎ প্রগতিমূলক চিন্তার পক্ষে অথবা তার বিপক্ষে। তিনি যে শ্রেণীকে সমর্থন করেন তার লেখায় সেই শ্রেণীর দৃষ্টিভঙ্গী প্রতিফলিত হবে। মহসিন শস্ত্রপাণি'র লেখায়-শিক্ষা, শিল্প অর্থাৎ গল্প, নাটক, গান ইত্যাদি বিষয়ে যা লিখেছেন তাতে তাঁর শ্রেণী চিন্তাই প্রতিফলিত হয়েছে। শ্রেণী দৃষ্টিভঙ্গীর ব্যাপারে তিনি অত্যন্ত সতর্ক ছিলেন। এক কথায় বলা যায় যে, তিনি বুর্জোয়া শ্রেণীর মতাদর্শকে বিরোধিতা করার ব্যাপারে কোন ছাড় দিতেন না। তাঁর প্রবন্ধগুলোতে স্পষ্টভাবে দেখা যাবে যে, তিনি প্রগতিশীল চিন্তাকেই প্রাধাণ্য দিয়েছেন এবং প্রতিফলিত করেছেন ষাট ও সত্তরের দশক থেকেই। তাঁর প্রবন্ধগুলোকে এখনো জীবন্ত বলে মনে হয়।
তিনি ছিলেন বিপ্লবী সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অগ্রপথিক ও সংগঠক এবং নেতা। পাকিস্তান আমলের শেষ পর্যায়ে উন্মেষ গঠিত হয় ১৯৬৮ সালে। তখন পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে উন্মেষের সম্পর্ক ছিল। সভাপতি ছিলেন প্রয়াত বিশিষ্ট লেখক জহুরুল ইসলাম। এই সম্পর্কের কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন প্রয়াত মহসিন শস্ত্রপাণি- তিনি ছিলেন প্রচার সম্পাদক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে সরাসরি যুক্ত। পল্টনের মঞ্চে ১৯৭০ ও ১৯৭১ সালের মার্চ পর্যন্ত তিনি হাজার হাজার মানুষের সামনে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছেন সাধারণ জনগণকে জনগণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা করার যুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করার জন্য। এ ঘটনা অবশ্যই স্মরণযোগ্য। প্রগতিশীল বিপ্লবী সংস্কৃতি কি হবে- তাঁর ব্যাখ্যা দিয়েছেন তিনি তাঁর লেখায়, তুলে ধরেছেন স্পষ্টরূপরেখা।
উন্মেষের নাটক ও গণসংগীতের আসর ৬৮-৭১ এর কৃষক গণঅভ্যুত্থানকে উদ্দীপ্ত ও স্পর্শ করেছে। তা অনেকেই ভুলে যাননি। উন্মেষের প্রগতিশীল তথা
সমাজতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি তখনকার অনেক লেখক ও শিল্পীকে উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করেছে। আজ জোর দিয়ে একথা বলা যায় যে, মহসিন শস্ত্রপাণি ছিলেন উন্মেষের মধ্যমণি। তাঁর জ্ঞান-প্রজ্ঞা, দৃষ্টিভঙ্গি- সাংস্কৃতিক অঙ্গনকে উজ্জীবিত রেখেছিল। আজ তিনি বেঁচে না থাকলেও তিনি এক সময়ে এর পুরোধা ছিলেন। মহসিন শস্ত্রপাণি গল্প, প্রবন্ধ ও কবিতা লিখতেন। কখনও কখনও গানও লিখতেন- বিশেষ করে তা ছিল গণসংগীতের পর্যায়ভুক্ত।
মহসিন শস্ত্রপাণি বহু বছর 'উন্মেষ' সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। এই পত্রিকা সবসময় প্রগতিশীল চিন্তাকেই তুলে ধরেছে। এছাড়া তিনি সম্পাদনা করেছেন বাংলাদেশ-চীন ইন্সটিটিউটের সংকলনগুলো। এতে আন্তর্জাতিক মহাবিতর্কের বিভিন্ন লেখা প্রকাশ পেয়েছে যেগুলোতে সমাজতান্ত্রিক চীনের সমাজতন্ত্র সুপ্রতিষ্ঠিত এবং স্পষ্ট। তিনি সারাজীবন আপোষের বিরোধিতা করেছেন। তিনি বলেছেন প্রগতিবাদিতা ও এর বিরোধিতার মতবাদের মধ্যে আপোষ চলে না। তিনি সরাসরি কম্যুনিস্ট পার্টিতে ছিলেন বহু বছর ধরে। সেখানে কোথাও তিনি আপোষের পক্ষে ছিলেন না। তাঁর প্রবন্ধগুলোতেও তা স্পষ্ট।
এই বইটিতে মহসিন শস্ত্রপাণি'র লেখা বেশ কিছু অগ্রন্থিত প্রবন্ধ, মতামতমূলক লেখা ও একটি ভ্রমণকাহিনী সন্নিবেশিত করা হয়েছে। এই লেখাগুলো মহসিন শস্ত্রপাণি লিখেছেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা-যুদ্ধ উত্তর সময়ে। এসব লেখায় তিনি অনায়াস সাধ্যে ও অকপটে স্বাধীনতা-পূর্ব ও স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক ও জনগণতান্ত্রিক আন্দোলন, গণসঙ্গীত, মওলানা ভাসানী'র অবদান, শহীদ আসাদের সংগ্রাম ইত্যাদি নিয়ে তাঁর বিশ্লেষণ, ও সুপরামর্শ প্রকাশ করেছেন প্রগতিশীল সমাজতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে।
সমাজতান্ত্রিক জ্ঞান-প্রজ্ঞা, দৃষ্টিভঙ্গি ও মতাদর্শ থেকে লেখা প্রবন্ধগুলো এখনকার প্রজন্ম ও প্রগতিশীল ও উদারপন্থী পাঠক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের কর্মী-নেতা, এবং অনেক লেখক-শিক্ষক-ছাত্র-শিল্পীকে উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করবে এবং প্রেরণা ও শক্তি যোগাবে বলে আশা করি।
যারা সমাজ বদলের স্বপ্ন দেখেন তারা মহসিন শস্ত্রপাণি'র লেখাগুলো থেকে বিশ্বাসযোগ্য উপাদান খুঁজে পাবেন, এগিয়ে চলার পথে আলো পড়েছে তা দেখতে পাবেন। পাঠকেরা প্রবন্ধগুলো থেকে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার পথের আলো খুঁজে পেলেই মনে হবে মহসিন শস্ত্রপাণি'র লেখা সার্থক হয়েছে। আমি এই গ্রন্থের বহুল প্রচার কামনা করি।