ইতিহাস সাধনায় আমরা অনেক পিছিয়ে, সন্দেহ নেই। আমাদের সঠিক ও সত্য ইতিহাসের অনেককিছু এখনো অনাবিষ্কৃত অবস্থায় রয়েছে । অন্যান্য দেশ ও জাতির তুলনায় পিছিয়ে থাকার এটাও একটি কারন। ইতিহাস হলো একটি জাতির স্মৃতি-দর্পন। বৃটিশরা এদেশকে জবর দখলের পর থেকেই আমাদের ইতিহাস ঐতিহ্যকে মুছে ফেলতে তৎপন হয়ে উঠেছিল। কারন তারা জানে, একটি জাতিকে ধ্বংস করতে হলে তাদের শিক্ষা ও সংস্কৃতির কবর রচনা করতে হবে। পলাশী পরবর্তী সময়ে থেকে ভারত উপমহাদেশের মুসলিম সমাজ বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। উপনিবেশিক শাসকরা শক্তির জোরে সমস্ত কিছু থেকে তাদের পূর্ববর্তী শাসকদের চিহ্ন লোপাটের মিশনে হাত দেয়। বিকৃত ইতিহাস পরিবেশনের লক্ষ্যে মিথ্যা, অসত্য জালতথ্য এবং সত্যকে পরিবর্তনের মাধ্যমে ভারত উপমহাদেশের মুসলমানদের ইতিহাস, ঐতিহাসিক চরিত্র ও ঘটনাবলীকে মূল থেকে উচ্ছেদ করে ফেলে। সত্য ইতিহাসের ওপর মাটিচাপা দিয়ে তৈরী করে অপবাদের ইতিহাস। ইতিহাস বিমুখতা ও বিভ্রান্তির ঘোর সৃষ্টি করে রাখে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য ।
ঔপনিবেশিক শাসকদের অত্যাচার অনিয়ম এবং নিপীড়িত মুসলিম সমাজের স্থবির জড়তা —দুটোই কবি নজরুলকে পীড়িত করেছিল। বহুদূর থেকে উড়ে আসা সাদা শকুনদের ‘জ্বালাময় বিধি বিধান’কে ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে নতুন সমাজ সৃষ্টির ডাক দিয়েছেন তিনি। ,সমাজ মানসকে শানিত করার হাতিয়ার হয়ে ওঠেছিল তাঁর সাহিত্য। কবি ‘হলাহল শিখ ভূজগ শিশু ‘দের ডাক দেন ‘তুবড়ি বাঁশীর ডাক।” এই অমঙ্গল অভিশাপ আর শনির জ্বালানো রুদ্র-চুল্লির মধ্যে বসে তোমাদের নবসৃষ্টির সাধনা করতে হবে”। তাঁর মতো এমন উদ্দীপ্ত ভাষায় পৃথিবীর আর কেউ কোনো কালে মানুষকে জাগ্রত করতে পারেনি। নজরুলের ‘তুবড়ি বাঁশীর ডাক’ যুগে যুগে নির্যাতিত মানুষকে পথের দিশার ডাক দিয়ে ফেরে।
এ ডাক পরাধীনতা, শোষণ ও বঞ্চনা, নিপীড়িকদের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠার ডাক। এর মূলমন্ত্র হলো স্বাধীনতা, স্বাধীনভাবে বাঁচার লড়াই শুরু করা। নিজেদের ইতিহাস, সাহিত্য,ভাষা নতুন করে সৃষ্টির প্রেরণার ডাক। যুগে যুগে নজরুল তাই অপরিহার্য হয়ে ওঠেন।
নিজেদের ইতিহাস অনুসন্ধান ও ইতিহাসকে পরিশুদ্ধ করার গুরুত্ব অপরিসীম। নতুন প্রজন্মকে ইতিহাসমুখী করে তোলা জাতীয় জীবনের অস্তিত্বের মতোই জরুরী। ড. ইউসুফ আল কারজাভি বলেছেন—” প্রত্যেক জাতির ইতিহাসের মূল উপাদান তার সন্তানদের লালন-পালনের মধ্যে লুক্কায়িত থাকে। কোনো জাতির ইতিহাস যদি সুপ্রষ্ঠিত ও মর্যাদাপূর্ণ হয়, তাহলে বিশ্বের সর্বত্র তাদের প্রভাব পরিস্ফুট থাকে। তাই প্রত্যেক জাতির কর্তব্য হলো, তারা তাদের গৌরবময় ইতিহাস-ঐতিহ্য থেকে শিক্ষা গ্রহন করবে। যেভাবে মানুষ অতীতের ভুল ও দুর্বলতা থেকে শিক্ষা গ্রহন করে থাকে।”
একথা আজ দিনের আলোর মতোই স্পষ্ট যে, আমাদের ইতিহাস মিথ্যা ও বিকৃতিতে সয়লাব। বৃটিশরা একদিকে আমারেকে দীর্ঘকাল ধরে লুট করেছে, শিক্ষা-সংস্কৃতি ধ্বংস করেছে এবং সম্পদ, লাইব্রেরির মূল্যবান পান্ডুলিপি আত্মসাৎ করেছে দুইহাতে। অপরদিকে আমাদের ঐতিহাসিক বীরদের হত্যা করে তাদের নামে রটিয়েছে মিথ্যা বিকৃত তথ্য ও গালগল্প। এ মিথ্যা কুয়াশার পর্দা ছিঁড়ে নতুন দিনের সূর্য আবিষ্কারের দায় নিজেদেরই। ইতিহাসের পুর্নপাঠ, গবেষণা, চাপাপড়া তথ্য আবিষ্কার, হস্তান্তর হওয়া ইতিহাসের উপাদানকে ফিরিয়ে আনার দুরূহ কাজে আত্মনিয়োগ জরুরী।
কবি নজরুল বলেছেন—”সত্য যখন ঘুমিয়ে থাকে, তখন অসত্যের দৌরাত্ম্য চলেতে থাকে। সত্য জেগে উঠলেই অসত্যের দৌরাত্ম্য দূর হয়।”
কবি ঘুমিয়ে পড়া জাতির জাগরনে ‘তুবড়ি বাঁশির ডাক’ হেঁকেছেন। সে ডাকের প্রয়োজন শেষ হয়নি। কবির কবিতা ও জাগরনের ডাক আজও সমান প্রাসঙ্গিক এবং আজও যুগের কর্ণেন্দ্রীয় সে ডাকের অপেক্ষায়। সে ডাক শুনে উত্তরসূরিরা ব্রতী হবো ইতিহাসের ধূলিরাশি মোছনে, জন্জাল বিতাড়নে।