গত বিংশ শতাব্দীতে ইউরোপে ইতালির মুসোলিনি ও জার্মানির হিটলারের হাত ধরে রাষ্ট্রক্ষমতায় ফ্যাসিবাদের উত্থান ঘটে। তথাপি সমাজ-সভ্যতার ক্রমবিকাশের সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে ফ্যাসিবাদ সম্পৃক্ত ছিল। দাস সমাজে দাস মালিকদের হাতে দাসরা, সামন্ত সমাজে সামন্তপ্রভুর হাতে প্রজারা এবং ধনতান্ত্রিক পুঁজিপতি বুর্জোয়া সমাজে পুঁজিপতিদের হাতে সর্বহারা শ্রমিকশ্রেণিসহ সাধারণ মানুষ নিপীড়িত- নির্যাতিত ও শোষিত হয়ে আসছে। আর এ সকলই একধরনের ফ্যাসিবাদী শাসনই বটে!
তবে ইতালিতে বিংশ শতাব্দীতে এসে এর নবতর সংযোজন ‘ফ্যাসিবাদ’ নামে উত্থান ঘটে। যার ধারাবাহিকতায় হিটলার তার দেশ জার্মানিতে এই তত্ত্ব আমদানি করে। মূলত সস্তা সেøাগান সর্বস্ব উগ্র জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে রাষ্ট্রের সুবিধাবঞ্চিত জনগণের ন্যায্য দাবিকে সামনে এনে জাতীয়তাবাদী প্রপঞ্চের উদার গণতন্ত্রের নামে এরা একধরনের ধূম্রজাল সৃষ্টি করে ক্ষমতায় আরোহণ করে। তবে তাদের মূল লক্ষ্য জনগণের স্বার্থরক্ষা নয়, বরং তাদের লক্ষ্য ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর স্বার্থ। আর সেভাবেই জণগণের ওপর চালায় ভয়াবহ কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থার নিবর্তনমূলক নিপীড়ন-নির্যাতন।
ফ্যাসিবাদ হলো উগ্র জাতীয়তাবাদের চূড়ান্ত কর্তৃত্ববাদী স্বৈরশাসনের অভিরূপ ব্যবস্থা। যা ঐন্দ্রজালিক গুরুবাদী নেতৃত্বের ওপর প্রতিষ্ঠিত এবং তাদের মন্ত্র ও মিথ হলো- এক নেতা, এক দেশ, এক বিশ্ব ব্যবস্থা। ফলে স্তাবকের দল নেতাকে দেবতারূপে অপদেবতার প্রতিরূপ হিসেবে ভক্তির আসনে অধিষ্ঠান করে। এর ফলে একটি অশুভ সঙ্ঘবদ্ধ লুণ্ঠনকারীচক্র গড়ে ওঠে। যা কি-না বিষাক্ত ভিমরুলের চাকের মতো। ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর স্বার্থের বাইরে এদের অন্য কোনো চিন্তা-ভাবনা নেই।
মনে রাখতে হবে- ফ্যাসিবাদের সবচেয়ে বড় বিরোধী শক্তি ও শত্রু হলো সমাজতন্ত্রীরা। কেননা, ফ্যাসিবাদ ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর স্বার্থ দেখে; অপরদিকে সমাজতন্ত্রীরা সর্বহারা শ্রেণির নেতৃত্বে সামাজিক মালিকানার রাষ্ট্র গঠন করে ন্যায্যতার ভিত্তিতে রাষ্ট্রের জনগণের সকল দায়িত্ব গ্রহণ করে।
বাংলাদেশে শেখ মুজিবের একদলীয় শাসন [১৯৭২-৭৫], এরশাদের সামরিক স্বৈরাচারী শাসনকাল [১৯৮২-১৯৯০] এবং সর্বশেষ শেখ হাসিনার দুই দফায় অবৈধ ক্ষমতায় থাকা [১৯৯৬-২০০২] এবং [২০০৯-২০২৪] বাংলাদেশে ভয়াবহ ত্রাসের ফ্যাসিবাদী শাসনেরই চূড়ান্ত রূপ।
দেড় হাজারের অধিক শহীদের বিনিময় ছত্রিশ জুলাই চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের পতন হয়ে দেশ এক নয়াদিগন্তের দ্বার উন্মোচন করে গণতন্ত্রের দিকে অগ্রসর হচ্ছে- যাকে স্বাগত জানানো জরুরি।
সম্পাদিত এই গ্রন্থে ফ্যাসিবাদের রূপরেখা এবং বাংলাদেশে বিগত ৫৩ বছরের বিভিন্ন সময়ে বীভৎস ফ্যাসিবাদের রূপচিত্র তুলে ধরার প্রয়াস মাত্র। আশা করা যায় বইটি পাঠকপ্রিয় হবে।
কবি ও গবেষক মুস্তাফা মজিদ এর রয়েছে ১০টি কাব্যগ্রন্থ। যথাক্রমে- ‘মেঘবতী সুবর্ণভূমি, “তােকে নিয়ে প্রেম প্রেম খেলা, কুসুমিত পঞ্চদশী’, ‘পুষ্পপত্রে নীলকণ্ঠ’, ‘জনযুদ্ধের কনভয়, ‘সাকিন সুবিদখালী’, ‘স্বাতীর কাছে চিঠি’, Diary of a Nepalese Guerrillas সম্পাদিত কবিতাসমগ্র ঃ মাও সেতুঙ এবং নিবেদিত কবিতা সংকলন ‘প্রাণিত রবীন্দ্রনাথ’ । এই কবি কবিতা লেখার পাশাপাশি বাংলাদেশে বসবাসরত। মঙ্গোলীয় ক্ষুদ্র নৃগােষ্ঠীর মানুষদের নিয়ে গবেষণার সঙ্গে সঙ্গে লােক প্রশাসন ও আমলাতন্ত্র নিয়েও গবেষণা করে আসছেন। বাংলাদেশের রাখাইন জাতিসত্তার আর্থ-সামাজিক ও প্রশাসনিক সমীক্ষা নিয়ে অভিসন্দর্ভ রচনার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচ ডি ডিগ্রী অর্জন করেন। যা বাংলাদেশের রাখাইন’ শিরােনামে বাংলা ভাষায় বাংলা। একাডেমী এবং The Rakhaines শিরােনামে ইংরেজি ভাষায়। ঢাকার মাওলা ব্রাদার্স থেকে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় । ড. মুস্তাফা মজিদের এ পর্যন্ত রচিত ও সম্পাদিত গ্রন্থ সংখ্যা। ৪০ উর্ধ্ব। তার উল্লেখযােগ্য গ্রন্থের মধ্যে ত্রিপুরা জাতি। পরিচয়’, ‘পটুয়াখালীর রাখাইন উপজাতি', আদিবাসী রাখাইন’, ‘মারমা জাতিসত্তা' বাংলাদেশে মঙ্গোলীয়। আদিবাসী’, ‘গারাে জাতিসত্তহজং জাতিসত্তা’, আদিবাসী সংস্কৃতি (১ম ও ২য় খণ্ড), রূপান্তরের দেশকাল’, ‘সমকালের আত্মকথন’, ‘লােক প্রশাসনের তাত্ত্বিক প্রসঙ্গ’, ‘বাংলাদেশের আমলাতন্ত্র', 'রাজনীতিতে সামরিক আমলাতন্ত্র’, ‘নেতৃত্বের স্বরূপ’, বাংলাদেশে বঙ্কিমচন্দ্র’, ‘মুক্ত ও মুগ্ধদৃষ্টির রবীন্দ্র বিতর্ক’ । আর ছােটদের জন্য রচিত ও সম্পাদিত গল্প গ্রন্থ। ‘দীপুর স্বপ্নের অরণি’, ‘জীবন থেকে’ ও ‘ছােটদের ৭টি মঞ্চ নাটক’ এবং জীবনী গ্রন্থ ‘রূপকথার নায়ক হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসন’ ও ‘বঙ্গবীর ওসমানী। মার্কসীয় মুক্ত চিন্তার যৌক্তিক দৃষ্টবাদে অবিচল মুস্তাফা মজিদ কৈশােরে উনসত্তরের গণ অভ্যুত্থান এবং একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে। অংশগ্রহণসহ কৈশাের থেকেই নানা সাংস্কৃতিক আন্দোলনে। জড়িত । বাংলা একাডেমীর জীবন সদস্য, জাতীয় কবিতা পরিষদ, ছায়ানট, ঢাকা থিয়েটার ও জাতীয় প্রেসক্লাবের সদস্য। এছাড়াও তিনি সত্তর ও আশির দশকে শিশু-কিশাের। সংগঠন গড়া ও নাট্য আন্দোলনে সম্পৃক্ত ছিলেন । পেশায় প্রথমে সাংবাদিকতা এবং পরে ১৯৮৪ থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তথা বাংলাদেশ ব্যাংকে কর্মরত আছেন। বর্তমানে মহাব্যবস্থাপক ড. মুস্তাফা মজিদ ১৯৫৫ সালের ১৪ই এপ্রিল পটুয়াখালী জেলার সুবিদখালীতে জন্মগ্রহণ করেন । ভ্রমণ করেছেন ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, সুইডেন, জার্মানী, বেলজিয়াম ও নেদারল্যান্ড।