একটি প্রজন্মের জাগরণ, একটি সময়ের দলিল
রবিউল আউয়াল রচিত “কোটা সংস্কার-আন্দোলন থেকে ২৪’র গণঅভ্যুত্থান” বইটি বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ইতিহাসে ছাত্র-জনতার অভূতপূর্ব জাগরণ ও রক্তাক্ত গণআন্দোলনের এক অসাধারণ প্রামাণ্য দলিল। এটি কেবল ঘটনাক্রমের বিবরণ নয়—বরং একটি প্রজন্মের স্বপ্নভঙ্গ, প্রতিরোধ ও বিজয়ের ধারাবাহিক সত্যনিষ্ঠ উপস্থাপনা।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও আন্দোলনের উৎস
বইটি শুরু হয়েছে কোটা ব্যবস্থা নিয়ে শিক্ষার্থীদের বহুদিনের ক্ষোভ ও দাবি নিয়ে। ২০১৩ সাল থেকে শুরু করে ২০১৮ এবং সর্বশেষ ২০২৪ সালের আন্দোলন—এই দীর্ঘ পথচলায় ছাত্রসমাজের প্রত্যয়ের ধারা স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে। ২০১৮ সালে শেখ হাসিনার সরকার প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরিতে কোটা বাতিলের সিদ্ধান্ত নিলেও, ২০২৪ সালের ৫ জুন হাইকোর্টের এক রায়ে তা পুনর্বহাল হয়। এই সিদ্ধান্তই নতুন করে উত্তাল করে তোলে দেশের ছাত্রসমাজকে, যার ফলশ্রুতিতে গড়ে ওঠে “বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলন”।
ছাত্র-আন্দোলনের থেকে গণঅভ্যুত্থান
লেখক নিপুণভাবে দেখিয়েছেন, কীভাবে শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক কোটা সংস্কার দাবি এক সময় সাধারণ জনগণের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট এক গণআন্দোলনে পরিণত হয়। “৩৬ দিনের আন্দোলন”, “লং মার্চ টু ঢাকা” এবং “কমপ্লিট শাটডাউন”—এই শব্দগুলো শুধু ঘটনাপুঞ্জ নয়, বরং একটি সময়ের প্রতিরোধচেতনার প্রতীক। আন্দোলনের প্রতিটি ধাপ লেখক সুসংগঠিতভাবে বর্ণনা করেছেন, যেন পাঠকের সামনে ফুটে ওঠে এক চলমান প্রতিরোধচিত্র।
নেতৃত্ব, সংগঠন ও কৌশলগত জাগরণ
বইয়ে উঠে এসেছে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সংগঠন গঠনের প্রক্রিয়া, নেতৃত্বের বিকাশ এবং মাঠপর্যায়ে পরিচালিত আন্দোলনের পরিকল্পনাগুলো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মাহফুজ আলম ওরফে আব্দুল্লাহসহ সারজিস, হাসনাত, নাহিদ ইসলাম, রিফাত রসিদ, আসিফ মাহমুদ, আবু বাকের মজুমদার, এবং আরিফ সোহেল প্রমুখ ছাত্রনেতাদের ভূমিকা এই আন্দোলনের কাণ্ডারী হিসেবে প্রতিভাত হয়েছে। “বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলন” গঠনের মধ্য দিয়ে আন্দোলনের মধ্যে শৃঙ্খলা ও সংগঠনের ছাপ স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
দমন-পীড়ন ও রক্তাক্ত ট্র্যাজেডি
লেখক অত্যন্ত সংবেদনশীলভাবে তুলে ধরেছেন কীভাবে অহিংস ছাত্রআন্দোলনটি সময়ের পরিক্রমায় রাষ্ট্রীয় সহিংসতায় রূপ নেয় এক রক্তাক্ত অধ্যায়ে। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদসহ প্রায় শতাধিক শিক্ষার্থী, সাংবাদিক ও শিশু-কিশোর শহিদ হয়, আহত হয় প্রায় চল্লিশ হাজার মানুষ। এই নিহতদের নাম-পরিচয় ও সংগ্রামের বিবরণ বইটিকে কেবল একটি প্রতিবেদন নয়, বরং একটি মানসিক দলিল হিসেবে তুলে ধরে।
রাজনৈতিক অভিঘাত ও গণতান্ত্রিক প্রশ্ন
রবিউল আউয়াল এই আন্দোলনকে কেবল চাকরির প্রেক্ষাপটের সংকটে সীমাবদ্ধ রাখেননি। তিনি দেখিয়েছেন কীভাবে রাষ্ট্রের সর্বত্র দলীয়করণ, মেধার অবমূল্যায়ন, আইনের শাসনের অনুপস্থিতি, ও প্রশাসনিক স্বেচ্ছাচারিতা একে-একটি প্রজন্মকে রাজপথে নামতে বাধ্য করেছে। লেখক মনে করেন, গণতান্ত্রিক চর্চা না থাকলে একটি জাতির ভবিষ্যৎ প্রশ্নবিদ্ধ হয়—এবং এই আন্দোলন সেই প্রশ্নের সামনে রাষ্ট্র ও সমাজকে দাঁড় করিয়ে দেয়।
অহিংস আন্দোলনের নৈতিক সৌন্দর্য
এই বইয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বার্তাগুলোর একটি হলো—“সহিংসতা নয়, যৌক্তিক অহিংসতাই গণতন্ত্রের প্রকৃত ভাষা।” শিক্ষার্থীরা যেভাবে সুসংগঠিত, স্থির, শান্তিপূর্ণভাবে নিজেদের দাবিকে সামনে এনেছে—তা একটি জাতির বিবেককে নাড়া দেওয়ার মতো। লেখক এই আন্দোলনকে “সৌন্দর্যের এক অনন্য দৃষ্টান্ত” হিসেবে চিহ্নিত করেছেন, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যও এক শিক্ষণীয় মানদণ্ড।
উপসংহার
“কোটা সংস্কার-আন্দোলন থেকে ২৪’র গণঅভ্যুত্থান” বইটি কেবল আন্দোলনের বিবরণ নয়—এটি একটি সময়ের রাজনৈতিক সচেতনতা, নৈতিক প্রশ্ন ও সামাজিক প্রতিরোধের দলিল। এটি প্রমাণ করে যে, রাজপথের প্রতিবাদ কখনো নিছক মুহূর্ত নয়—তা ভবিষ্যতের রাষ্ট্রচিন্তার বীজও। লেখক রবিউল আউয়াল ছাত্রসমাজের পক্ষ হয়ে, তাদের কণ্ঠস্বর হয়ে, ইতিহাসের দায় মেটাতে চেয়েছেন এই গ্রন্থে।
এই বই পড়ার পর যে প্রশ্নটি পাঠকের মনে গেঁথে যাবে তা হলো—“আমরা কী এমন একটি রাষ্ট্র চাই, যেখানে শিক্ষার্থীকে তার অধিকার চাইতে গিয়ে প্রাণ দিতে হয়?” লেখক যেন পাঠকের বিবেককে এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে নিতে আমন্ত্রণ জানিয়ে যান।