পেশাগত কাজে একজন সাংবাদিক সারাক্ষণই অনুসন্ধান করতে থাকেন। নতুন নতুন খবরের খোঁজে তথ্যের পেছনে ছোটেন। অনুসরণ করা খাতে নিজস্ব উৎস (সোর্স) তৈরি করেন। আবার কোনো প্রাথমিক তথ্যের ভিত্তিতে সোর্স খুঁজে বের করেন।তার মানে প্রতিটি প্রতিবেদনের পেছনেই একজন সাংবাদিকের জন্য কিছু না কিছু অনুসন্ধান করতে হয়।তবুও অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা আলাদা বৈশিষ্ট্য নিয়ে হাজির হয়।বিশেষ করে এতে থাকে ঘটনার গভীরতা আর বিস্তৃত বর্ণনা।
অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার আলাদা করে সংজ্ঞা দিয়েছেন অনেকে।যদিও এতে ভিন্নতা দেখা যায়।তবে তার মূল অর্থ একই।বিশেষ করে অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে যেসব উপাদান থাকে, তা নিয়ে খুব একটা ভিন্নতা দেখা যায় না।বরং একই রকম উপাদানের কথা বলেন সবাই।ইউনেস্কো প্রকাশিত স্টোরি–বেজড এনকোয়ারি নামের হ্যান্ডবুকে বলেছে, ‘অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার উদ্দেশ্য হচ্ছে, গোপন বা লুকিয়ে রাখা তথ্য মানুষের সামনে তুলে ধরা।সাধারণত ক্ষমতাবান কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে এসব তথ্য গোপন রাখে; কখনো হয়তো-বা বিপুল ও বিশৃঙ্খলভাবে ছড়িয়ে থাকা তথ্যের মধ্যে লুকিয়ে থাকে, যা চট করে খুঁজে পাওয়া কঠিন।এই কাজের জন্য একজন সাংবাদিককে সাধারণত প্রকাশ্য ও গোপন নানা উৎস ব্যবহার করতে হয়, ঘাটতে হয় নানা ধরনের নথিপত্র।’
কোনো একটি বিষয়ে বড় রকমের অনিয়ম, দুর্নীতি, অপরাধের গন্ধ পেলেই তা নিয়ে অনুসন্ধানে আগ্রহ তৈরি হয়।এর জন্য শুরুতেই একটি পরিকল্পনা তৈরি করে এগোতে হয় একজন সাংবাদিককে। ঘটনার গভীরে যেতে কিছু বিষয়ে গবেষণার প্রয়োজন হয়।এর জন্য সবসময়ই ঘটনার পেছনে ছুটতে হয়।সংগ্রহ করতে হয় প্রয়োজনীয় নথি। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে তুলে আনতে হয় নথির পেছনের গল্প।আর অতি অবশ্যই নিতে হয় অভিযুক্তের সাক্ষাৎকার।
এবার একটি অনুসন্ধানের গল্প বলি। অভিবাসন খাতে আমার নিয়মিত কাজের জায়গা। সবশেষ কর্মী নিয়োগে ২০২১ সালে সমঝোতা স্মারক সই করে বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়া। এরপর ২০২২ সালে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার চালুর পর থেকেই বিয়ষটি নিয়ে নানা সমালোচনা ছিল।নিয়মিত প্রতিবেদনও করেছি। তবে বাজারটি বন্ধের আগে এ নিয়ে গভীর অনুসন্ধানের আগ্রহ তৈরি হয়।এর জন্য শুরুতেই বিদেশে যাওয়া মোট কর্মীর ডাটাবেজ সংগ্রহ করেছি।অনুমোদিত পুরো ১০১টি এজেন্সি থেকে পাঠানো কর্মীর তালিকা নিয়ে এক্সেল শিটে তা বিশ্লেষণ করেছি। এতে বেরিয়ে এসেছে কোন এজেন্সি সবচেয়ে বেশি কর্মী পাঠিয়েছে।এরপর খুঁজে বের করেছি ওইসব এজেন্সির মালিকানার তথ্য।তাতেই কারও কারও রাজনৈতিক পরিচয় বের হয়ে এসেছে। তারপর খুঁজে বের করেছি ১০১টি এজেন্সি কিভাবে অনুমোদেন হলো। এতে বেরিয়ে এসেছে এক হাজার ৫২০ এজেন্সি থেকে টাকার বিনিময়ে তালিকা করার তথ্য।তালিকাটা করার পেছনে যারা যুক্ত ছিল তাদের তথ্য থেকেই পাওয়া গেছে মালয়েশিয়া চক্র তৈরির মূল গল্প। এরপর প্রবাসী কর্মী, বিদেশগামী, তালিকা ও তালিকার বাইরে থাকা এজেন্সি, সরকারি সংস্থা, বেসরকারি গবেষণা সংস্থাসহ সংশ্লিষ্ট অনেকের সঙ্গে কথা বলে বের করেছি চক্র কিভাবে কাজ করে।এর জন্য মূলত মালয়েশিয়া নিয়োগের স্বয়ংক্রিয় সফটওয়্যার নিয়ে গবেষণা করতে হয়েছে।এতেই টাকা লেনদেনের বিষয়গুলো স্পষ্ট হয়ে উঠে।জানা যায় টাকা পাচারের তথ্য।কেউ কেউ স্বীকার করেন অভিযোগের বিষয়টি। এরপর দুই পর্বে ছাপা হয় মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার চক্র নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন।
অনুসন্ধানে নিয়মিত কৌশল বদলায় সাংবাদিকেরা। ১৯৯০ সালে তথ্য বিশ্লেষণ ও চিত্রায়ণের জন্য কম্পিউটার ব্যবহার শুরু করেন অনুসন্ধানী সাংবাদিকরা।ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের প্রধান এবং ইনভেস্টিগেটিভ রিপোর্টার্স অ্যান্ড এডিটর্স এর সাবেক প্রধান নির্বাহী ব্র্যান্ট হিউস্টন বলেন, ‘অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা কাজ করার নতুন পথ দেখায়। এই কৌশলগুলো ধীরে ধীরে প্রতিদিনকার সাংবাদিকতার সঙ্গে মিশে যায় এবং শেষপর্যন্ত গোটা পেশারই মান বাড়ায়।’
অনুসন্ধানী সাংবাদিক হতে পারেন যে কোনো পেশাদার সাংবাদিক।একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করতে কখনো কখনো সপ্তাহ থেকে মাস গড়িয়ে যায়।আবার বিপুল ডাটা বিশ্লেষণ করে কোনো অনুসন্ধানে কয়েক মাসও লাগতে পারে। এর জন্য লেগে থাকার ধৈর্য প্রয়োজন। তথ্য সংগ্রহে নানা কৌশল অবলম্বন করতে হয়।আর সঙ্গে একজন মেন্টার বা অভিজ্ঞ পরামর্শক থাকলে তা আরও সহজ হয়ে ওঠে সাংবাদিকের জন্য। আমার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে অনেক ক্ষেত্রে।আবার কোনো কোনো প্রতিবেদনের পুরোটাই তৈরি হয়েছে একক অনুসন্ধানে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করেছি। সাংবাদিকতার পাঠ নিয়েছি সেখানেই। এরপর গত দুই দশকে বিভিন্ন সময় অনুসন্ধানীয় সাংবাদিকতার ওপর নানা প্রশিক্ষণ, কর্মশালায় অংশ নিয়েছি। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত অনুসন্ধানী প্রতিবেদন নিয়মিত পড়েও নিজেকে সমৃদ্ধ করার চেষ্টা করি।তবে মূল শিক্ষাটা আসলে পেয়েছি মাঠ থেকে।কাজ করতে করেতে শেখা; এটাই সবচেয়ে বেশি কাজে দিয়েছে।
বইয়ে সংকলন করা প্রতিবেদনগুলো বিভিন্ন সময় প্রথম আলো পত্রিকা ও অনলাইনে প্রকাশিত হয়েছে।একইসঙ্গে প্রতিবেদনগুলো অনুবাদ করে প্রথম আলো ইংরেজি সংস্করণেও প্রকাশিত হয়েছে। কোনো সম্পাদনা ছাড়াই প্রথম আলোয় প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলো নিয়ে বইটি সংকলনা করা হয়েছে। তাই প্রথম আলোর প্রতি বিশেষ কৃতজ্ঞতা।
মো. মহিউদ্দিন
ঢাকা, বাংলাদেশ