দুধভক্ত ভূত
ঋতু এই বাড়িতে নতুন উঠেছে। একতলা বাড়িটি বেশ বড়ো। আগের বাসার মতো ছোটোখাটো নয়। এই বাড়িতে এসে ঋতুর খুব আনন্দ হলো। কারণ তার নিজের একটি ঘর আছে।
রাতে বাবা ও মা ঘুমাতে তাঁদের ঘরে চলে গেলেন। ঋতু বই পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে গেল। মাঝরাতে ঋতুর ঘুম ভেঙে গেল। তার মনে হলো তাদের রান্নাঘর থেকে শব্দ আসছে এবং সেখানে কেউ আছে। সে ভয়ে ভয়ে রান্নাঘরে গেল। গিয়ে দেখল কেউ নেই। তবে রান্নাঘরের জানালা খোলা এবং ফ্রিজের মধ্যে রাখা সবটুকু দুধ শেষ। ঋতু ভাবল জানালা দিয়ে হয়তো বিড়াল এসেছিল। কিন্তু পরক্ষণেই ভাবল বিড়াল কীভাবে ফ্রিজ খুলবে? কোনো উত্তর মেলাতে না পেরে সে নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ল।
পরের দিন ঋতু সকালের নাশতা খেয়ে বাড়ির বাইরে হাঁটতে গেল। হাঁটতে হাঁটতে এক বুড়ির সাথে দেখা হলো। বুড়ি বলল, তুই কখনো দুধ খাবি না। ঋতু ভাবল বুড়িটি একটা পাগল। তাই কথার কোনো উত্তর না দিয়ে বুড়ির সামনে থেকে সরে গেল ঋতু। তবে বিষয়টি তার মনে দাগ কেঁটে গেল। বাসায় এসে বুড়ির কথা ভাবতে লাগল সে।
রাতে দুধ খেয়ে শুতে গেল ঋতু। মাঝরাতে হঠাৎ একটি আওয়াজ শুনে তার ঘুম ভেঙে গেল। কিন্তু এবার রান্নাঘর থেকে শব্দ আসছে না। আওয়াজটি আসছে পাশের বারান্দা থেকে। ঋতু ভয়ে ভয়ে বারান্দায় গেল। সেখানে একটি মেয়েকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সে যেন ভূত দেখল। প্রচণ্ড ভয় পেল সে।
মেয়েটির চোখ লাল, সাদা জামা পরা। মেয়েটি ঋতুর দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। ঋতু তাকিয়ে আছে মেয়েটির দিকে। মেয়েটি যতই আগাতে লাগল, ঋতুও এক পা দুই পা করে পেছনে যেতে লাগল। মেয়েটি বলল, ভয় পেয়ো না। আমি তোমার বন্ধু!
ঋতু : তুমি কে?
মেয়েটি : আমি ভূত!
ঋতু : হতেই পারে না; ভূত বলে কিছু নেই।
মেয়েটি : ভূত আছে। তুমি জানো না। তুমি আমার কথা শোনো। ভালো চাইলে এই বাড়ি থেকে চলে যাও। কারণ আমার মা কাউকেই ছাড়বেন না।
ঋতু : তোমার মা কেন কাউকেই ছাড়বেন না? আমাদের কী দোষ?
মেয়েটি : আচ্ছা, শোনো তাহলে। বাবা মারা যাবার পরে আমি আর মা এই বাসাতেই থাকতাম। দুধ আমার খুব প্রিয়। একদিন বাসায় দুধ শেষ দেখে মা দুধ আনতে বাইরে যান। আমি তখন বাসায় একা। আমাদের প্রতিবেশী কিছু লোক তখন বাসায় এসে আমাদের জিনিসপত্র নিয়ে যেতে থাকে। আমি দেখে ফেলায় তারা আমাকে একটি চেয়ারে হাত-পা বেঁধে বসিয়ে রাখে। তারা চলে যাওয়ার সময় আমাকে চেয়ারে বাঁধা অবস্থায় রেখেই বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়। আমি আগুনে পুড়ে মারা যাই। আমার মা বাসায় এসে আমার মৃত দেহ দেখে সেখানেই মারা যান। তারপর থেকেই আমার মা এই বাসায় যাকে পায়, তাকেই মারে।
ঋতু : বুড়িটি কি তোমার মা?
মেয়েটি : হ্যাঁ।
ঋতু : তোমার মা কেন আমাকে দুধ খেতে নিষেধ করেছেন?
মেয়েটি : দুধ আমার খুব প্রিয়। আর এই দুধ আনতে যেয়েই মা আর আমার মৃত্যু হয়। তাই এই বাসায় কেউ দুধ খেলে মা সহ্য করতে পারেন না।
ঋতু খেয়াল করল মেয়েটি কাঁদছে। কিন্তু সে কী বলবে বুঝতে পারছিল না। তবে তার খুব মন খারাপ হলো। মেয়েটি ও তার মায়ের জন্য মায়া লাগল। হঠাৎ মেয়েটি কোথায় যেন হারিয়ে গেল। মন খারাপ নিয়ে ঘুমাতে গেল ঋতু।
এই ঘটনার পরে ঋতু দুধ খাওয়া ছেড়ে দেয়। রাতে মা ঋতুকে যে দুধ খেতে দেন, তা প্রতিদিনই সে রান্নাঘরের জানালার পাশে রেখে দেয়। সকালে দেখা যায় দুধের গ্লাসটি খালি। এভাবে কিছুদিন ভালোই চলছিল। কোনো সমস্যা ছিল না বাসায়। হঠাৎ একদিন বাসার কাজের মেয়েটি নিখোঁজ হয়ে গেল। মেয়েটির নাম শিল্পী। তারও দুধ খুব পছন্দের ছিল। বাসার সবাই মেয়েটির গ্রামের বাড়িসহ সব জায়গায় খুঁজেও তাকে পেল না। থানা-পুলিশও কোনো খোঁজ দিতে পারল না। লোকজন শিল্পীর নিখোঁজ হওয়া নিয়ে বিভিন্ন কথা বলতে লাগল। তাই বাধ্য হয়ে ঋতুরা বাসাটি ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল।
ঋতুরা বাসা খালি করে মালামাল নিয়ে গাড়িতে উঠতেই বাসাটির সামনের অংশ ভেঙে পড়ল। একটুর জন্য বড়ো একটি দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে যেয়ে সবাই যখন নিজেদের খুব ভাগ্যবান ভাবছিল, তখন ঋতুর মনে পড়ল গভীর রাতে বারান্দায় দেখা মেয়েটির কথা। বুঝতে পারল, ঐ মেয়েটির কথাগুলো সত্যি ছিল।
ভাঙা বাড়িটা এখনো আছে। তবে এর ধারে-কাছেও কেউ যায় না। সবাই বলে, ওটা একটা ভূতের বাড়ি। ঋতু এই ঘটনা থেকে একটা নীতিশিক্ষা পেল। আর তা হলো :
“অন্যায়ের ফল সবসময় খারাপ হয়।”