শ্রী কৃষ্ণকুমার মিত্র যখন 'মহম্মদ চরিত' বইটা লিখেন, তখন বর্তমানের মতো তথ্য এত সহজলভ্য ছিল না। যেহেতু তখন বাংলা ভাষায় মহানবী (সা.)-এর আর কোনো জীবনী ছিল না, তাই স্বাভাবিকভাবেই তাকে বিদেশি ভাষার বইয়ের সাহায্য নিতে হয়েছিল। তবে সেসময় বাংলা তল্লাটে মহানবী (সা.)-কে নিয়ে রচিত বিদেশি বইয়ের সংখ্যাও খুবই অপ্রতুল ছিল। এতসব প্রতিকূলতার মধ্যেও কৃষ্ণকুমার মিত্রের এই প্রচেষ্টা প্রশংসাযোগ্য। তিনি নানান জায়গা থেকে ঘেঁটে ও তথ্য সংগ্রহ করে বেশ সহজবোধ্য করে বাঙালি পাঠকদের জন্য বইখানা রচনা করেছেন। মহানবী (সা.) এর প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা বজায় রেখে তার জীবনী ও মহানুভবতা বাঙালি পাঠকদের সামনে তুলে ধরেছেন। তিনি শুধুমাত্র মুসলিমদের জন্য নয়, বরং হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সকল ধর্মের মানুষদের জন্যই বইটি রচনা করেছিলেন, যাতে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীরাও মহানবী (সা.) এর মহানুভবতার কথা জানতে পারে, পাশাপাশি জানতে পারে ইসলাম ধর্মের কথাও।
স্বদেশী আন্দোলন, ব্রাহ্ম আন্দোলন, বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন ইত্যাদির সংস্পর্শে থেকে শ্রী কৃষ্ণকুমার মিত্র অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উদ্বুদ্ধ ছিলেন। সমাজে অসাম্প্রদায়িক চেতনা ছড়িয়ে দেয়ার পাশাপাশি সমাজ সংস্কারেও ভূমিকা রেখে গেছেন আজীবন। তৎকালীন সমাজে ধর্মীয় ভেদাভেদ ও সাম্প্রদায়িক চেতনার যে বিষবাষ্প ছড়িয়ে পড়েছিল, সেটা দূর করার উদ্দেশ্যেই তিনি গৌতম বুদ্ধ ও মহানবী (সা.)-এর জীবনী লেখায় মনোনিবেশ করেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি সমাজ থেকে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প দূরীকরণে অগ্রণী ছিলেন।
পাঠকের মনে একটা প্রশ্ন আসতে পারে-
বর্তমানে তথ্যপ্রযুক্তির উন্নতির ফলে মহানবী (সা.) সম্পর্কে সব তথ্যই এখন আরও সুলভে পাওয়া যায়। বিভিন্ন বিশদ সীরাতগ্রন্থও বাজারে এভেইলেবল। সেক্ষেত্রে দেড়শো বছর আগে সীমিত তথ্যে রচিত বইটার তুলনায় বর্তমান যুগে পাওয়া তথ্যের গ্রহণযোগ্যতা ও নির্ভরযোগ্যতা অনেক বেশি। তবুও কেন কৃষ্ণকুমার মিত্র রচিত এই বইটি পড়ব?
এর উত্তরে বলা যায়-
এই মহান লেখকের চেষ্টা ও অবদানকে পুনরায় পাঠকদের সামনে তুলে ধরার প্রয়াস এটি। পাশাপাশি একজন অমুসলিমের দৃষ্টিতে আমাদের মহানবী (সা.)-এর মহত্ত্ব ঠিক কতটুকু ছিল, সেটাও জানা যাবে এই বইটি পড়ার মাধ্যমে।
বর্তমান সমাজেও সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে আছে সর্বত্র। বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও সহনশীলতা কমছে, বাড়ছে ঘৃণা ও অবিশ্বাস। সমাজের এই পরিস্থিতিতে সহশীল, মননশীল ও অসাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনার মানুষ আরও বেশি প্রয়োজন। শ্রী কৃষ্ণকুমার মিত্র ছিলেন তেমনই একজন। ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা বাড়ানোর ক্ষেত্রে শ্রী কৃষ্ণকুমার মিত্র হতে পারেন অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব।
পাঠক এই বইটি পড়ার মাধ্যমে এই মহান লেখকের দৃষ্টিভঙ্গির সাথে পরিচিত হোক, তার প্রচেষ্টাকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করুক, তার অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠুক-এটাই কামনা।