ইংরেজ ঔপনিবেশিক বাংলার সমাজ-রাষ্ট্র, পুঁজিতন্ত্র আর সামন্তাদর্শের অন্তর্গূঢ় তমস-অন্ধকারের চালচিত্র এই উপন্যাস। ইতিহাসের জটিল সুড়ঙ্গপথ বেয়ে আসা পাকিস্তানি রাষ্ট্রের সমরতান্ত্রিক শৃঙ্খল মুক্তির কল্পে আসে একাত্তরের যুদ্ধ এবং রক্তাক্ত বিজয়। সেই বিজয়ের সাহিত্য-শিল্প রূপায়ণের পাশাপাশি তেভাগা আন্দোলন, সমাজ বিপ্লবের প্রস্তুতি এবং একাত্তর পরবর্তী শ্রেণি সংগ্রামের কাল ও কালান্তরের প্রামাণ্য শিল্প দলিল ‘অজগর’ উপন্যাস। বাঙালি সমরতন্ত্রের উত্থানের মধ্যদিয়ে যে কূটকৌশলে ধর্মান্ধ যুগের পুনরায়োজন চলে এবং গভীর ষড়যন্ত্রের পথ ধরে রাষ্ট্র ও রাজনীতির চরিত্র হনন করে কৃষিভিত্তিক সমাজ জীবনকে গ্রাস করে দুঃশাসনের অজগর, ঔপন্যাসিক তারই রূপকার। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের নামে ছদ্মবেশী সেনা-আমলাতন্ত্র সাম্রাজ্যবাদের প্রতিভূ হিসেবে শৃঙ্খলবন্দি করে আর্থরাজনীতিকে। মুক্তিযুদ্ধের গণতান্ত্রিক চেতনাকে চরিত্রহীন রাজনীতির পুনরুজ্জীবনের মধ্য দিয়ে কিভাবে উৎপাটনের চেষ্টা চলে, এই বাস্তবতা হচ্ছে উপন্যাসটির তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়-ভাবনা। যুদ্ধোত্তর দেশে পরিকল্পিত দুর্ভিক্ষ এবং বিরাষ্ট্রীয়করণের নামে লুণ্ঠন প্রক্রিয়ার চিত্রায়ণ এই উপন্যাসের কাহিনি বিন্যাসের তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়।
সামাজিক দায়বদ্ধ ঔপন্যাসিক তাঁর শিল্পসত্যকে শাণিত করেছেন নিগৃহীত গণমানুষের ঐক্যবদ্ধ অবিনাশী শক্তির দ্বারা। লেখক উন্মোচন করেছেন পুঁজিতন্ত্র আর সামন্ততন্ত্র দ্বারা উৎপীড়িত মানুষের সঙ্ঘ শক্তিকে। মুক্তিকামী মানুষকে আশান্বিত করতে চেয়েছেন সঙ্ঘ শক্তির হাতে নিহত পুঁজিতন্ত্র আর সামন্ততন্ত্রের অজগরের লাশের সামনে দাঁড় করিয়ে। সমাজ বাস্তবতার ত্রুটি-বিচ্যুতিকে চিহ্নিত করতে গিয়ে লেখক এটিও দেখিয়েছেন যে, অনল ক্ষুধার কৃষ্ণ অজগরের মৃত্যু ঘটলেও তার রক্তবীজে বারবার জন্ম নেয় ভয়ঙ্কর সরীসৃপ। তাই লেখক তীর্যক প্রশ্নের সামনে টেনে নেন পাঠককে, ‘অজগরের কি মৃত্যু নেই?’ সে কারণেই ঔপন্যাসিক শিল্পের প্রস্থানভূমিতে দাঁড়িয়ে গণমানুষের আগামী বিজয়ের স্বপ্নে তাড়িত হন।
উপন্যাসটির বহির্বলয় রাজনীতি হলেও অন্তর্বলয় সামাজিক। গণমানুষের সঙ্ঘশক্তির স্বপ্নের ভেতরও ব্যক্তি মানুষের প্রেম-পিপাসা, নীড়বাসনা, দুঃখ-বিষাদ এবং প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি একই অখণ্ড আবর্তের অবিচ্ছিন্ন অংশ হিসেবে উপন্যাসে স্থিতি লাভ করেছে। ঔপন্যাসিকের পরিশ্রমী শিল্প জিজ্ঞাসায় একটি অখণ্ড জাতিজীবন এবং ব্যক্তিজীবনের জটিল বাস্তবতাকে আধার এবং আধেয় করা হয়েছে ‘অজগর’ উপন্যাসে।
হরিপদ দত্ত। জন্ম : ২ জানুয়ারি ১৯৪৭ খ্রি. গ্রাম : খানেপুর, উপজেলা : পলাশ, জেলা : নরসিংদী। উল্লেখযোগ্য উপন্যাস: অজগর, জন্মজন্মান্তর, দ্রাবিড় গ্রাম, মোহাজের, চিম্বুক পাহাড়ের জাতক (৪ খণ্ড) প্রভৃতি। গল্প সমগ্র, প্রবন্ধ সমগ্র ও শিশু-কিশোর সমগ্র প্রকাশিত হয়েছে। পুরস্কার : বাংলা একাডেমি পরিচালিত সাদ’ত আলী আকন্দ সাহিত্য পুরস্কার ২০০১ এবং বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ২০০৬ (উপন্যাস)।