বাংলার ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির অন্যতম উপাদান পুথিসাহিত্য। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রাচীন, মধ্য ও আধুনিককাল পর্বে এই ধারাতে বিকশিত হয়েছিল বহু কাব্যিক আখ্যান, সাধনতত্ত্ব, জনজীবনের অসংগতির বিবরণ ইত্যাদি। শুরু থেকেই পুথি বাংলার সামাজিক ইতিহাসের ধারক, বাহক। তাই বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলের অনেকেরই জানার বাইরে ইউরোপ আমেরিকার বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিন্নভাষী বহু পণ্ডিত গবেষক বাংলা শিখে আমাদের পুথিসাহিত্যের অমৃত ভাণ্ডার নিয়ে উচ্চতর গবেষণা সম্পন্ন করেছেন। কিন্তু আমাদের নাগরিক মানুষের তথাকথিক গতিশীল জীবনের আলো থেকে বাংলার ঐতিহ্যবাহী পুথিকাব্য অন্ধকারে ছিটকে পড়েছে। কাব্য কামরুল পরম মমতায় বাংলা মায়ের সেই অধিকার বঞ্চিত সন্তানকে তুলে নিয়েছেন আপনার বুকে ও কণ্ঠে। অধিকার বঞ্চিত সন্তানের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে কাব্য কামরুল এমন একটি বুদ্ধিদীপ্ত পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন, যে পদ্ধতিতে পুথিসাহিত্য নতুন করে নাগরিক জীবনে গৃহীত হয়ে উঠেছে। কাব্য কামরুলের পুথি রচনার পদ্ধতি সমসাময়িক মানুষের জীবনচিত্র, মনের কথা, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সংকটের কথামালা সহজ ও সত্য ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে। অন্যদিকে তাঁর পুথিচর্চার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে – তিনি স্বভাব-কবির মতো সুর করে যে কোনো স্থানে দাঁড়িয়ে বা বসে, সুর করে উচ্চস্বরে পুথি পাঠ করে সাধারণ ও অসাধারণ দুই প্রজাতির মানুষকে আহ্বান করেন তার সত্য ভাষণের দিকে। কাব্য কামরুলের পুথিচর্চার নিরন্তর জীবনাচারকে কাব্য-সাধনার নতুন পথ বলে উল্লেখ করা যেতে পারে।
কাব্য কামরুল দীর্ঘদিন ফ্রান্সে বসবাস করছেন। কিন্তু প্রবাসজীবনের কর্মময় ও ইউরোপীয় জীবন যাপনের নতুন বাস্তবতায় ভুলে যাননি তাঁর ঐতিহ্যচারী পুথিচর্চার ধারা। বরং ঐতিহ্যচারী এবং স্বদেশপ্রেমী তীব্র এক অনুভূতিসম্পন্ন কবির আবেগ ও দৃষ্টিতে প্রবাসজীবনের কথামালা ও ফেলে যাওয়া স্বদেশের প্রতি অকৃত্রিম টান ও ভালোবাসাকে রূপায়ণ করেছেন পুথিকাব্যে। কাব্য কামরুলের ‘পরবাসের পুথি’তে একজন প্রবাসী পুথি-কবির স্বদেশ প্রেমের যে মর্মগাথা বর্ণিত হয়েছে, তা শুধু কবির ব্যক্তিজীবনের কথা নয় প্রতিটি প্রবাসীর অন্তর্বয়াণ। এখানেই কাব্য কামরুলের কবি হিসেবে সাফল্য।
কাব্যের জয় হোক, বাংলার পুথিসাহিত্যকে নতুন মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা করার জন্য কাব্যের সাধনা পূর্ণ হয়ে উঠুক।
কাব্য কামরুল-এর জন্ম এবং বেড়ে ওঠা খুলনা ও মংলায়। পড়াশােনা করেছেন মংলা, খুলনা ও ঢাকায়। ছােটবেলা থেকেই শিল্প-সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত। তার বড় পরিচয় তিনি একজন পুথিশিল্পী। সমসাময়িক বিষয়কে উপজীব্য করেই তার পুথিকবিতা। নিজেই লেখেন নিজেই তা পাঠ করেন অপূর্ব ভঙ্গিমায়। চিরাচরিত গ্রামীণ বাংলার সুর আর সমকালীন ঘটনার মেলবন্ধনে তার পুথি যেন হাজারাে মানুষের কণ্ঠস্বর । লেজার ভিশন থেকে প্রকাশিত হয়েছে অ্যালবাম কাব্য কামরুল-এর পুথি (২০১০)। বাংলা সাহিত্যের বিশিষ্ট ইতালীয় অনুবাদক বর্তমানে বাংলাদেশের সম্মানিত নাগরিক ফাদার মারিনাে রিগনের জীবন ও কর্ম নিয়ে গবেষণা করছেন। মাওলা ব্রাদার্স থেকে ফাদার রিগনকে নিয়ে সম্পাদিত তার গ্রন্থের নাম ফাদার রিগন : নিভৃত কোলাহল (২০০৬)। পেশাগতভাবে তিনি মিডিয়াসংশ্লিষ্ট কাজের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন নন্দিত একাধিক নাটক, চলচ্চিত্র, প্রামাণ্যচিত্র ও টকশাে নির্মাণ কাজে। ভ্রমণ করেছেন ভারত, ইতালি ও ফ্রান্স।