আত-তিব্বুন নববী গ্রন্থ সংকলন
চিকিৎসার ক্ষেত্রে আত-তিব্বুন নববি বা আল-ইলাজুল মুহাম্মাদি হলো শ্রেষ্ঠতম ও উপকারী চিকিৎসা। তিব্বুন নববি সম্পর্কে একজন মুসলিম-মুমিনের এই ঈমান থাকা আবশ্যক। এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ থাকার কোনো অবকাশ নেই।
মুসলমানরা যুগে যুগে এই তিব্বুন নববি বা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত চিকিৎসা পদ্ধতি দিয়ে উপকৃত হয়েছেন। তিব্বুন নববি দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে সহিহ সূত্রে বর্ণিত হওয়া সকল প্রকার চিকিৎসাপদ্ধতি ও সূত্র।
প্রত্যেক যুগের হাদিসবিশারদরা তাদের সংকলিত হাদিসগ্রন্থে স্বীয় সূত্রে ‘তিব্বুন নববি’ বর্ণনা করেছেন। এর ধারাবাহিকতায় ইমাম মালিক, বুখারি, মুসলিম, আবু দাউদ, তিরমিযি, নাসায়ি, ইবনে মাযাহ ও অন্যান্যরা তাদের সংকলিত হাদিসগ্রন্থে ‘কিতাবুত তিব্ব’ নামক একটি আলাদা অধ্যায় সংকলন করেছেন।
‘আত-তিব্বুন নববি’-এর বিষয়ে অনেকে প্রথক কিতাব সংকলন করেছেন। এসব গ্রন্থে তিব্বুন নববি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। পাশাপাশি স্থান পেয়েছে প্রত্যেক যুগের সমকালীন চিকিৎসাবিদ্যা-সংক্রান্ত আলোচনা। তিব্বুন নববি সম্পর্কে যে সমস্ত কিতাবে বিশেষভাবে আলোচনা ও বিশ্লেষণ স্থান পেয়েছে, সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলোÑ
১. আত-তিব্বুন নববি, ইমাম আবু বকর ইবনুস সুন্নি (রহ.) (মৃত. ৩৪৬হি.),
২. আত-তিব্বুন নববি, ইমাম আবু নুয়াইম আহমাদ ইসপাহানি (রহ.) (মৃত.৪৩০হি.),
৩. আত-তিব্বুন নববি, ইমাম শামসুদ্দিন মুহাম্মাদ ইবনু আহমাদ যাহাবি (রহ.) (মৃত. ৭৪৮হি.),
৪. আল-আহকামুন নববিয়্যাহ ফিস সিনায়াতিত তিরবিয়্যাহ, ইমাম আবুল হাসান আলি ইবনু আবদুল কারিম আল-হামাভি (রহ.) (মৃত.৭২০হি.)
৫. আত-তিব্বুন নববি, ইমাম শামসুদ্দিন আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মাদ ইবনে আবু বকর আল-জাওযিয়্যাহ (রহ.) (মৃত. ৭৫১হি.)।
যুগ যুগ ধরে ইবনুল জাওযিয়্যাহ (রহ.)-এর রচিত ‘আত-তিব্বুন নববি’ আলেমদের কাছে একটি গ্রহণযোগ্য গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। ৭৫১ হিজরি তথা আজ থেকে প্রায় ৭শ’ (৬৯২) বছর পূর্বে ইবনুল কায়্যিম আল-জাওযিয়্যাহ রহ. ইন্তেকাল করেন। অর্থাৎ, অষ্টম হিজরির প্রথম দিকে তিনি এই গ্রন্থটি সংকলন করেন। চমৎকার বিন্যাসপদ্ধতি ও সাবলীল উপস্থানের মাধ্যমে গ্রন্থটিতে ক্স চিকিৎসাব্যবস্থার নানা রকম তথ্য-উপাত্ত সংকলন করেছেন ।
আত-তিব্বুন নববি গ্রন্থের আলোচ্য বিষয়
ইবনু কাইয়্যিম আল-জাওযিয়্যাহ (রহ.)-এর পুরো গ্রন্থের সারকথা হলো, যেকোনো রোগের চিকিৎসার ক্ষেত্রে পূর্বাপর আমাদের ৫টি পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে। এগুলো হলো :
১. রোগ আসার পূর্বেই সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। যেমন : খাবার গ্রহণের পরিমাণ মেপে খাওয়া এবং নিজের অভ্যাসের দিকে খেয়াল রাখা।
২. রোগাক্রান্ত হওয়ার পর কোনোভাবেই রোগ যেন বৃদ্ধি না পায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। অর্থাৎ, আক্রান্ত হওয়ার সাথে সাথে সঠিক নিয়ম মেনে চিকিৎসা করানোর ব্যবস্থা করা ।
৩. রোগীকে রূহানি তথা আত্মিক চিকিৎসা করতে হবে। অর্থাৎ, আত্মিকভাবে আল্লাহ তাআলার শরণাপন্ন হতে হবে। যিকির-আযকার, তাসবিহ-তাহলিল, সাদকা- খইরাত ও যথাসাধ্য সব রকমের ইসলামি শরিয়াত স্বীকৃত ইবাদতগুলো করে আল্লাহ তাআলার কাছে আরোগ্যের জন্য প্রার্থনা করতে হবে।
৪. যুগের প্রচলিত বৈধ চিকিৎসাসেবা গ্রহণ করতে হবে। শুধু আল্লাহর ওপর ভরসা করে চিকিৎসাব্যবস্থা অস্বীকার বা বর্জন করা যাবে না। আবার যুগের আধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থা গ্রহণ করে আল্লাহকে বিস্মৃতি হওয়া যাবে না।
৫. রোগের চিকিৎসার ক্ষেত্রে সর্বপ্রথম চেষ্টা করতে হবে, নির্দিষ্ট রোগকে খাবার, ফল-ফলাদি, শাক-সবজি ও বনজ গাছ ইত্যাদি দিয়ে নিরাময় করা যায় কি না। কারণ, খাবারের মাধ্যমে যদি রোগ ভালো করা যায়, তাহলে তা মানবদেহের জন্য সার্বিক কল্যাণকর।
‘আত-তিব্বুন নববি’ গ্রন্থটি একটি গবেষণাগ্রন্থ। ৭ শ বছর পূর্বে রচিত গ্রন্থটি ছিল চিকিৎসাবিজ্ঞানের এক অতুলনীয় ও সমৃদ্ধ উপহার। আধুনিক যুগেও এই গ্রন্থটি চিকিৎসা ও চিকিৎসাবিজ্ঞানের অগণিত দিক ও বিষয় নিয়ে বিশ্লেষণমূলক এবং যৌক্তিক পর্যালোচনা করেছে। আমাদের অনূদিত গ্রন্থটিতে লেখক প্রথমে ছয়টি পরিচ্ছেদ ভূমিকাস্বরূপ নিয়ে এসেছেন। গ্রন্থটিকে তিনি চারটি ভাগে ভাগ করেছেন। যথা-
১. বিভিন্ন রোগ ও চিকিৎসাপদ্ধতির বিবরণ।
২. বিভিন্ন রোগের ইলাহি চিকিৎসা। অর্থাৎ, কুরআন ও হাদিস শরিফে বর্ণিত আযকার ও দোয়া মাধ্যমে রোগ ভালো করা ।
৩. চিকিৎসার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত প্রাণী, বৃক্ষ, বনজ লতা-পাতা, শাক-সবজি ইত্যাদি বিষয়ের বিবরণ।
৪. স্বাস্থ্য-সচেতনতামূলক বিবিধ বিষয়ের বিবরণ।
ইবনুল কাইয়্যিম (রহ.) ‘আত-তিব্বুন নববি’ গ্রন্থে সর্বমোট ১২৫টি পরিচ্ছেদে উল্লিখিত বিষয়গুলো বর্ণনা করেছেন।
আত-তিব্বুন নববি কিতাব কতিপয় বৈশিষ্ট্য
‘আত-তিব্বুন নববি’ কিতাবটির কতিপয় বৈশিষ্ট্য রয়েছে।
১. বিভিন্ন ধরনের রোগের বর্ণনা।
২. আরোগ্য লাভের মাধ্যম বা চিকিৎসাপদ্ধতি বর্ণনা।
৩. রোগ নিরাময়ের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য-খাবারের বিবরণ।
৪. নির্ধারিত রোগের ক্ষেত্রে কুরআনে কারিম ও সহিহ হাদিস থেকে, নির্দেশনা।
৫. যেকোনো রোগের ক্ষেত্রে প্রাথমিক করণীয়-বিষয়ক নির্দেশনা।
৬. দিক সাথে কেমন আচরণ করতে হবে তার ব্যাখ্যামূলক বর্ণনা।
৭. আদর্শ চিকিৎসকের গুণাবলি ও করণীয়-বর্জনীয় বিষয় বর্ণনা।
৮. প্রতিটি বিষয়ের দলিল- প্রমাণ-সহ আলোচনা।
৯. চিকিৎসা-বিষয়ক ভুল ধারণা, কুসংস্কার ও জাল হাদিসের বিভ্রান্তি নিরসন।
১০. আধুনিক ও প্রাচীন পদ্ধতির সমন্বয়ে চিকিৎসা পদ্ধতি ইত্যাদি।