শ্বেত পাথরের থালা
জমিদার শীতল চন্দ্র চাটুর্যে
কয়েক গ্রামের জমিদার।
ছিলেন নিয়মনিষ্ঠ ভালো মানুষ।
প্রত্যুষে হাঁটতেন সফেদ ধুতি পরিহিত
জামায় চেইন যুক্ত সোনার বোতাম লাগিয়ে
আদ্দির গিলে করা পঞ্জাবি পড়ে
চামড়ার চকচকে পাম’সু পায়ে পড়ে
হাঁটতেন এ পাড়ায় সে পাড়ায়।
এর বাড়ির গাছের একটি রক্তজবা
ওর বাড়ির একটি মালতি কিংবা বেলী
আরেক বাড়ির গন্ধরাজ
গাছ থেকে তুলে নিতেন,
রাখতেন ছোট্ট সুদৃশ্য পিতলের ঝুড়িতে।
হাঁটতে হাঁটতে খোঁজ খবর নিতেন
কে কেমন আছে, কার কি সমস্যা?
এ রকম প্রজাবৎসল জমিদার হয় না।
প্রাসাদে ফিরে ফুলগুলো সাজাতেন
একটি বড় শে^ত পাথরের থালায়
লক্ষ্মী দেবীর পূজার নৈবেদ্য।
তিনি গড় হয়ে প্রণাম করতেন দেবীকে।
প্রণামেই বলতেন,
মা গো দেশ ভাগ হতে চলেছে
এই দেশ না কি মুসলমানের হবে মা!
হিন্দুরা থাকতে পারবে কি না জানি না।
কি হবে মা আমাদের, কি হবে?
তোমাকে ছেড়ে মা গো
এই সাত পুরুষের ভিটে ছেড়ে
কেমনে থাকবো ওপারে গিয়ে?
তুমি দয়া করো মা, দয়া করো
আমাকে পথ দেখাও।
আরও কতকি বলতেন তিনি
কতো কাকুতি মিনতি।
পূজার ঘরের থালাটিকে মানতেন
লক্ষ্মীর গুপ্ত ধনভান্ডার হিসেবে।
বাড়িতে পাঁচ ছেলের বৌ এনেছেন।
এই থালায় আলতা গোলা পানিতে
পা ভিজিয়ে নিকানো উঠোনে হাঁটিয়ে
পায়ের ছাঁপ দেখে তবে ঘরে তুলছেন।
পূত্র বধুরা বড়ই পয়মন্ত
আচার আচরণে, কথায় বার্তায়
এবং সেবা যতনে।
সবই থালার আশির্বাদ।
১৯৪৭ খৃষ্টাব্দ সাল।
শেষ পর্যন্ত দেশ ভাগ হয়েই গেলো,
মা লক্ষ্মী নিশ্চুপ রইলেন
পথ দেখালেন না।
শীতল বাবু তার জমিদারীর তালুক
চুপে চুপে বিক্রি করলেন
এলাকার ধনাঢ্য মুসলমানদের কাছে।
যার কাছ থেকে যেমন দাম পেলেন তাই।
ভাগ্যের প্রতীক শে^ত পাথরের থালাটি
তিনি বিক্রয় করলেন না,
দান করলেন প্রিয় মহিম আলীকে।
তিনি চলে গেলেন হিন্দুস্তানে।
থালাটি ছিলো যক্ষের ধনের মতো
মহিম আলীর কাছে।
রেখে দিয়েছিলেন ঘরের মাচার উপর
একটি কাঠের বাক্সে।
মহিম আলীর মৃত্যুর পর
তার ছেলে ইউসুফও রক্ষা করেছেন
প্রয়াত পিতার স্মৃতি হিসেবে।
১৯৭১ খৃষ্টাব্দ সাল।
থালাটি চুরি করলেন
ইউসুফের যুবক পূত্র আনোয়ার,
বিক্রয় করলেন ষাট টাকায়।
কিছু টাকা মায়ের কাছ থেকে নিলেন
বই কলম খাতা কেনার নামে,
অতঃপর ঝোলাব্যাগ একটা কাঁধে নিয়ে
রাতের অন্ধকারে বেড়িয়ে গেলেন।
শরনার্থী কাফেলার সাথে
সূদীর্ঘ পথ হেটে বা নৌকায় চড়ে গেলেন
ওপারের ট্রেনিং ক্যাম্পে।
পেলেন গেরিলা যোদ্ধার ট্রেনিং।
আগ্নেয়াস্ত্রে ফুলথ্রো করা শিখলেন,
রাইফেল, স্টেন গান, মর্টার চালনা এবং
গ্রেনেড চার্জ শিখলেন।
দেশে ফিরে অসুর শক্তির সাথে জড়ালেন
তুমুল রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে।
পায়ে গুলি খেলেন, — থামলেন না,
বাম হাতের আঙ্গুল ছিন্ন হলো
তবুও থামলেন না।
ডান হাতে স্টেন চালিয়ে
দাঁতে পিন খুলে গ্রেনেড ছুঁড়ে
একের পর এক বাঙ্কার দখল করলেন।
বিজয় ছিনিয়ে আনলেন দেশের।
২০২১ খৃষ্টাব্দ সাল।
স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর।
বানিজ্য মেলার সুদৃশ্য ইরানী স্টলে
শে^ত পাথরের থালা দেখেন
হুইল চেয়ারে বসা পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা
আনোয়ার হোসেন।
এমন একটি থালা বিক্রি করে গিয়েছিলেন
দেশমাতৃকাকে মুক্ত করার যুদ্ধে।
আনোয়ার অপলক তাকিয়ে থাকেন
শে^ত পাথরের থালায়।
থালায় পূজার নৈবেদ্যের ফুল নেই
তিনি থালায় দেখেন পিতার মুখের ছবি
এবং গর্বিত স্বাধীন পতাকা।
ঢাকা
২৭ মার্চ ২০২১।