ভূতের পাঠশালা
গ্রামে প্রায় আশি বছরের পুড়নো একটি বট গাছ, বট গাছের পাশে বাজার, প্রতিদিন সকাল বিকাল হাঁট বসে। এই ইউনিয়নের মধ্যে সবচেয়ে বড় বাজার। বট গাছের সামনে প্রাইমারি স্কুল ডান পাশে হাই স্কুল এবং সামনে খেলাধুলার বিশাল মাঠ। পিছনে মেঘনা নদীর শাখা। ইউনিয়নের মধ্যে একমাত্র হাই স্কুল, আর কোন ধরনের বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নেই গ্রামে। এই ইউনিয়নের সকলেই এই স্কুলে পড়ে। স্কুলে সরকারিভাবে একটি টিন শেড বিল্ডিং বরাদ্দ এসেছে। এই টিন শেডটি মূলত করা হয়েছে স্কুল লাইব্রেরীর জন্য। ছাত্র ছাত্রীদের তুলনায় ক্লাসের সংকট। এখানে বিজ্ঞান গ্রুপে ক্লাস গুলো করা হয়। যে দিন গ্রুপের ক্লাস থাকে সেদিন এই বিল্ডিংয়ের দুটি রুম খুলে দেওয়া হয়।
তাছাড়া এই রুম গুলো তেমন খোলা হয় না। স্কুলে বিজ্ঞান বিভাগে একজন নতুন শিক্ষিকা যোগদান করছেন। বাড়ি অনেক দূর। বিশাল মেঘনা নদী পাড়ি দিয়ে ম্যাডাম কে স্কুলে আসতে হয়।
মেঘনা নদীটি পাড়ি দিতে প্রায় চল্লিশ মিনিট সময় লাগে। নদীর পর একটি গ্রাম এই গ্রামে থেকে স্কুলে যেতে সময় লাগে প্রায় ত্রিশ মিনিট, তারপর একটি খেয়া পার হয়ে স্কুলে পৌঁছাতে হয়। যা ম্যাডামের জন্য খুব কষ্টকর। কাল বৈশাখী ঝড়ে নদীতে এমন ঢেউ হয় যেন নৌকা ডুবো ডুবো অবস্থা।
মাঝে মধ্যে ম্যাডাম ক্লাসে এসে নদীর ঝড়ের কথা বলে কান্না করতেন। তাছাড়া সন্ধ্যা নদীতে ঢেউ বেশি থাকলে নৌকা চলাচল বন্ধ থাকে। একদিন নদীতে হঠাৎ ঝর উঠে, নৌকা নদীর ঠিক মাঝ খানে। নৌকা ঢেউয়ে একবার উপরে উঠে আবার নিচে। এবাবে পাঁচ মিনিট যাওয়ার পর হঠাৎ নৌকা ডুবে যায়। পাশেই একটি মাছ ধরা নৌকা ছিল। জেলেদের সহযোগিতায় এই যাত্রায় প্রাণে বেঁচে যায়। পরের দিন ম্যাডাম স্কুলে এসে সিদ্ধান্ত নিলেন, তিনি স্কুলের চাকরি করবেন না। অনেক ভেবে চিন্তে প্রধান শিক্ষকের নিকট গিয়ে সমস্ত ঘটনা খুলে বললেন এবং চাকরি না করার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলেন। প্রধান শিক্ষক বলেন আপনি চাইলে আপনার জন্য নদীর এ পাশে আমরা থাকার ব্যবস্থা করতে পারি।
আমাদের স্কুলের লাইব্রেরী দুটি রুম খালি আছে, আপনি চাইলে কিছু ছাত্রী নিয়ে এখানে থাকতে পারেন। আপনার ছেলে মেয়ে কে স্কুলে ভর্তি করে দিবেন। তাদের ও পড়াশোনা কোন অসুবিধা হবে না, স্যারের কথা শুনে ম্যাডাম একটু আশা পেলেন।
আচ্ছা স্যার আমি বাড়িতে সবার সাথে পরামর্শ করে আপনাকে জানাবো। পরের দিন পরিবারের সাথে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নিলেন এখানে থাকবেন। প্রধান শিক্ষক স্কুলের আশপাশে থেকে চারজন ছাত্রী কে বললেন ম্যাডামের সাথে থাকতে এবং তাদের অভিভাবককেও বলে দিলেন। ম্যাডাম কিছুদিন পর সব কিছু নিয়ে লাইব্রেরীর দুটি কক্ষে উঠলেন।
হঠাৎ একদিন রাতে কারা যেন ঘরের মধ্যে ঢিল ছঁুড়ছে এবং ভয়ংকর শোঁ শোঁ শব্দ করতে থাকে। ম্যাডাম ভাবছে হয়তো কিছু দুষ্ট ছেলেরা দুষ্টামি করতেছে। কিছুক্ষণ এভাবে থাকার পর আর কোন শব্দ হচ্ছে না। ম্যাডাম ভেবে নিলো দুষ্ট ছেলেরা হয়তো দুষ্টামি করছে। এক সপ্তাহ পর আবার ও একই সমস্যা। কিন্তু
আগের চেয়ে একটু বেশি পরিমানে ঢিল ছঁুড়ছে বিকট শব্দ, সাথে থাকা ছাত্রীরাও অনেক ভয় পেলো। কিছুক্ষণ পর আগের দিনের মত চুপচাপ। ম্যাডাম ভেবে নিলো দুষ্ট ছেলেরাই এ কাজটি করছে। সকালে ম্যাডাম স্কুলের প্রধান শিক্ষককের নিকট বিষয়টি শেয়ার করলেন। স্যার বললেন আচ্ছা আপনি ভয় পাবেন না, আমি এর ব্যবস্থা নিচ্ছি। প্রধান শিক্ষক এলাকার নেতৃত্ব স্থানীয় কিছু মুরব্বিদের এবং স্কুল কমিটির সাথে এ ব্যপারটি তুলে ধরেন। তারা বলেন ম্যাডাম কে বলেন লোকগুলো চিনে রাখতে। বাকি কাজ আমরা করবো। ম্যাডামকে ডেকে স্কুল কমিটির সদস্যরা বলে দিলেন আবার এরকম করলে আপনি বাহিরে এসে কিছু না বলে শুধু লোকগুলোকে চিনে রাখেন।
এই ব্যাপারটি সবার সাথে শেয়ার করার পর এক সপ্তাহের মধ্যে আর কিছু হলো না। ইতোমধ্যে স্কুলের সকলে ব্যাপারটা জেনে গেলো। এক সপ্তাহ পর আবার ও শুরু হলো, আজকে মনে হচ্ছে টিনের চাল ছিঁড়ে নিয়ে যাবে। এমন সময় ম্যাডাম বাহিরে এলো, এসে দেখে কোন লোক নেই। আজকে মতো বন্ধ হয়ে গেলো। মাঝে এক সপ্তাহের বিরতি। এক সপ্তাহ পরে আবার ও শুরু হলো, আজকে এমন মনে হচ্ছে দশ থেকে পনের জন মিলে চালের মধ্যে ঢিল ছুড়ছে। বিকট বিকট শব্দ, আশেপাশে বাড়ি অনেক দূরে। কেউ নেই যে ম্যাডামকে সহযোগিতা করবে। ম্যাডাম অবশ্যই আজকে কিছুটা সাহসী হয়ে উঠে।
ম্যাডাম মনের মাঝে সাহস নিয়ে বাহিরে এলো। বাহিরে আসার সাথে সাথে আর কোন শব্দ নেই। যদিও মনে মাঝে ভয় কাজ করতেছে। একটু সাহস নিয়ে সামনে এগিয়ে গেলো। আশেপাশে কেউ নেই। আস্তে আস্তে বট গাছের নিচে গেলো, কিছুক্ষণ এদিক ওদিক দিখে নিলো কেউ তো নেই। কে এরকম করে, ম্যাডাম ভাবতে লাগলো। কোনো সমাধান খোঁজে পাচ্ছে না,
হঠাৎ জুড়ে বাতাস লাগলো গায়ে। অনেক ভয় পেলো, হাত পা কাঁপতে শুরু করলো। ভূত নয় তো? হঠাৎ করে যেনে ম্যাডামকে ঝাপটে ধরে উপরে নিয়ে যাচ্ছে, কিছু বুঝার আগে কে যেনো গাছের উপরে নিয়ে ডালের মধ্যে বসিয়ে দিলো। তখন ম্যাডাম সাহস হারায়নি।
কাঁপা কাঁপা সুরে কে তুমি?
উত্তর এলো আমাকে চিনবে না।
আপনাকে কে এত সাহস দিয়েছে আমাদের এই পাঠশালায় থাকার। আমরা এখনে নিয়মিত পড়াশোনা করি, কিন্তু এক মাস যাবত আপনি আমাদের ক্ষতি
করেছেন। ভাবছিলাম প্রথম দিন ভয় দেখানোর পর চলে যাবেন, কিন্তু না, আপনার সাহস দেখে অবাক হচ্ছি। যখন কথাগুলো বলছিলো ম্যাডামের চোখ দুটি বন্ধু ছিল হঠাৎ চোখে ঘন কালো চেহারা, গায়ে লম্বা লম্বা চুল, চোখগুলো বড় বড়, হাতে নখ গুলো বিশাল বিশাল। একবার এই চেহার দেখার সাথে সাথে অজ্ঞান হয়ে গেলো। অনেক সময় হয়ে গেলো ম্যাডাম বাসায় আসছে না। ছাত্রীরা অনেক ভয় পাচ্ছে, তারা ভয়ে চিৎকার করতে লাগলো। পাশের দূরে কেউ একজন রাতে বাড়ি বাহিরে আসলে তাদের চিৎকারের শব্দ শুনতে পায়। তখন এই লোক সাথে আর কিছু লোকজন নিয়ে আসে। তারা কান্নার জন্য কিছুই বলতে পারছে না। একজন ঘটনা খুলে বললো, ম্যাডাম বাহিরে গেছে অনেক সময় হলো এখন আসেনি। সকলে খোঁজতে লাগলো কিন্তু খোঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এই খবর এলাকায় ছড়িয়ে পরে, এলাকার মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। স্কুলে ছেলে মেয়েরা খুব কম আসছে। শিক্ষকদের মাঝেও আতঙ্ক বিরাজ করছে। কেউ কেউ সন্ধ্যা হলে ঘর থেকে বাহিরে আসতে ভয় পাচ্ছে।