সাফল্যের কথা সব সময় আলোচিত হয় কিন্তু যারা এর নেপথ্য—কারিগর তারা আলোচনায় আসেন না। ১৯৫২ থেকে ২০২০ পর্যন্ত বাংলাদেশে অনেক ধরনের আন্দোলনও হয়েছে, শহিদও হয়েছেন অনেকে। কিন্তু আজ পর্যন্ত তাদের নাম, বিবরণ তৈরি করা সম্ভব হয়নি। মুক্তিযুদ্ধ তো বিশাল ব্যাপার। সেখানে শহিদদের সম্পূর্ণ বিবরণ তৈরি করা সম্ভব নয়। এ দেশটির অদ্ভুত কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। এ দেশের মানুষ মুখস্থ পড়ার মতো বলে, ত্রিশ লক্ষ শহিদের বিনিময়ে এ দেশটি অর্জন করা হয়েছে। কিন্তু তেমনভাবে কখনও শহিদ পরিবারগুলির খেঁাজ করেনি, নাম সংরক্ষণ করার কথাও ভাবেনি। এ দেশে ছয়বার মুক্তিযোদ্ধাদের নামের তালিকা করে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে এক ধরনের পরিহাস করা হয়েছে। সবাই তালিকাভুক্ত হতে চায়, কারণ তাতে অনেক সুযোগ—সুবিধা। আবার মুক্তিযুদ্ধকে বলা হয় ‘জনযুদ্ধ’। কিন্তু তালিকা করে ‘জনদের’ আলাদা করা হয়েছে। বলা হয়, শুধু তারাই মুক্তিযোদ্ধা যারা দেশরক্ষা করেছেন। এদেশটি এমনই যে—শহিদদের মোট সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে, রাজনৈতিক বির্তক তৈরি হয়েছে। পাকিস্তানপন্থী, ডান ও চরম ডান রাজনৈতিক দল থেকে একটি প্রচারণা চালানো হয় যে, মুক্তিযুদ্ধে এত মানুষের মৃত্যু হয়নি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে সংবাদদাতারা শহিদের সংখ্যা নিয়ে জিজ্ঞেস করায়, তিনি ‘থ্রি মিলিয়ন’ বলেছেন। আসলে সংখ্যাটি হবে তিন লাখ। এ প্রচারণার মাধ্যমে তারা বলতে চান, পাকিস্তানি সৈন্য ও তাদের বাঙালি সহযোগীদের হত্যালীলা সম্পর্কে যা বলা হয় তা অতিরঞ্জিত। কেননা তাদের ধারণা শেখ মুজিবুর রহমান তেমন শিক্ষিত ছিলেন না। তারা বঙ্গবন্ধুর দেয়া ইংরেজি ভাষণ বা আত্মজীবনী হয়তো পড়েননি।
আজ এত বছর পর অনেকে সে—প্রচেষ্টা গ্রহণ করেছেন দেখে আনন্দিত হয়েছি। এদের একজন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর। তিনি মানিকগঞ্জের স্থানীয় একটি কলেজে শিক্ষকতা করেন। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নিরন্তর গবেষণা করছেন। দুই খণ্ডে তিনি প্রকাশ করেছেন ‘জনযুদ্ধে মানিকগঞ্জের শহিদ জনতা’ নামের গ্রন্থ। দুই খণ্ডে শহিদদের সংখ্যা ৪০৮ জন। এটি স্বীকার্য যে, তিনি মানিকগঞ্জের প্রতি শহিদদের নাম তালিকাভুক্ত করতে পারেননি, সম্ভবও নয়। যেমন অনেক গণহত্যার কথা মানুষ ভুলে গেছে। নদী ভাঙনে অনেক গণহত্যা, বধ্যভূমি, গণকবর হারিয়ে গেছে। এক জেলার লোক অন্য জেলায় শহিদ হয়েছেন। তবুও তিনি যে ৪০৮ জন শহিদের বিস্তারিত তালিকা সংকলন করতে পেরেছেন তা সত্যিই বিস্ময়কর। শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর এর চেয়ে উৎকৃষ্ট উপায় আর জানা নেই। আশা করি অন্যান্য জেলার গবেষকরাও এ ধরনের কাজে এগিয়ে আসবেন। পাঠক মহলে এ বইয়ের বহুল প্রচার প্রত্যাশা করি।