বাঁকাউল্লার বারোটি কাহিনিতে যে শুধু গোয়েন্দা কাহিনির উপাদান এবং বিষয়বস্তু রয়েছে, তা নয়। বাঁকাউল্লার সমকালে পুলিশের কার্যপদ্ধতি, সরকারি নিয়ম, প্রশাসন চালানোর পদ্ধতি, উপরওয়ালাদের মতিগতি প্রভৃতি সম্পর্কেও ধারণা করা যায়। আর চেনা যায় সেকালের সমাজকে। তৎকালীন গ্রাম্য ও শহুরে মানুষের মানসিকতা, সাধারণ সমাজে নারীর অবস্থান, এদেশের মানুষের কূটবুদ্ধি ও দুর্বুদ্ধি প্রভৃতির স্বচ্ছ আভাস পাওয়া যায় বাঁকাউল্লার গল্পগুলি থেকে। আন্দাজ পাওয়া যায় সেকালের বিচারব্যবস্থা সম্পর্কে।
এইসব কারণে প্রথম প্রকাশের সওয়া-শো বছর পার করেও 'বাঁকাউল্লার দপ্তর' প্রাসঙ্গিকতা হারায়নি এখনও।
বাঁকাউল্লার দপ্তর আসলে কার লেখা এ-নিয়ে বিস্তর বিতর্ক আছে। বিতর্ক আছে এই কাহিনিটি কার জীবনের কাহিনি, সেটা নিয়েও। কেউ বলেন এটা বরকতুল্লা খাঁর জীবননির্ভর কাহিনি। তিনি উনিশ শতকের তিনের দশকের শেষদিকে বা চারের দশকে পুলিশে ছিলেন।
মানে মিয়াজানদারোগার প্রায় সমসাময়িক। আবার কেউ মনে করেন এটি এক্সট্রা অ্যাসিস্টাস্টে কমিশনার অফ পুলিশ মুনশী বাঁকাউল্লার জীবনের কাহিনি।
পদোন্নতির আগে তিনি দারোগা পদে বহাল ছিলেন। এই কাহিনির লেখক হিসেবে মুনশী বাঁকাউল্লা বরকতউল্লা, কালীপ্রসন্ন চট্টোপাধ্যায় এমনকি কেউ কেউ প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়েরও নাম করেন।
এই কাহিনিগুলি মোটামুটিভাবে উনিশ শতকের চার, পাঁচ ও ছয়ের দশকের ঘটনা অবলম্বনে রচিত। এই গ্রন্থের প্রকাশকাল সঠিক করে জানা না গেলেও ১৮৯৬ সাল বা তার আগে এই গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে মনে করা হয়। বাংলা ক্রাইম ফিকশনের অন্যতম পথিকৃৎ বাঁকাউল্লার দপ্তর।
বাঁকাউল্লার দপ্তরে দেখা যায় তৎকালীন পুলিশের গোয়েন্দারা কিভাবে ছদ্মবেশে বা ছদ্মপরিচয়ে তদন্ত চালাতেন, কেমন করে ফাঁদ পাততেন অপরাধীকে ধরতে, শুধু গায়ের জোর নয় রীতিমতো মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব বিস্তার করেও অপরাধীকে দোষ কবুল করতে কিভাবে বাধ্য করতেন তাঁরা। আশ্চর্য হয়ে দেখতে হয় গোয়েন্দাগিরি বা পুলিশি তদন্তের কাহিনি শোনাতে গিয়ে কেমন মোক্ষম ভাষ্য বলে গিয়েছেন দারোগা বাঁকাউল্লা। এই ধরনের বহু সামাজিক অবস্থা বা পরিস্থিতি বিষয়ক মন্তব্য গল্পের মধ্যে বাঁকাউল্লা করে গিয়েছেন, যা তাঁর দূরদৃষ্টি প্রমাণ করে।
প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত হাওড়া দেওয়ানী আদালতের আইন ব্যবসায়ী। পেশাগত বিষয় ছাড়া প্রত্নতত্ত্ব, শিল্পকলা, রহস্য, গোয়েন্দা ও ভৌতিক সাহিত্য, বিদেশি ছায়াছবি প্রভৃতির প্রতি প্রসেনজিতের গভীর অনুরাগ। শখ বেড়ানো, বইপড়া আর ফোটোগ্রাফি। ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক স্মৃতিবিজড়িত এবং ধর্মীয় ঐতিহ্য সম্বলিত স্থানের প্রতি তাঁর বিশেষ আকর্ষণ। লেখালেখির বিষয় ভ্রমণকাহিনি, প্রত্নতত্ত্ব, রহস্য ও গোয়েন্দা বিষয়ক আলোচনা। প্রকাশিত বই: ভ্রমণকাহিনি সংকলন: পথে চলে যেতে যেতে। প্রত্ন বিষয়ক: খাজুরাহো, মান্ডু, ভারতের মন্দির ভাস্কর্যে সমাজ ও সংসার, ইলোরা প্রত্ন ও শিল্প, ওরছা: স্মৃতির শহর, রহস্যের তাজমহল, সাঁচি, কোনারকের ভাস্কর্য। রহস্য ও গোয়েন্দা বিষয়ক আলোচনা: সাহিত্যের গোয়েন্দা, রহস্যের রানি আগাথা ক্রিস্টি, গোয়েন্দাচরিত, সাসপেন্সের সম্রাট হিচকক্, ফেলুদা আর সত্যজিৎ ।