আক্রমণ যখন বহুমাত্রিক হয়, প্রতিরোধও তখন বহুমুখী হয়ে ওঠে। বহিরঙ্গে শুধু নয়, আঘাতের পর আঘাত গভীর ক্ষত করেছে ভারতের অন্তরঙ্গে। ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক ও যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো যা আমাদের সংবিধানের নির্যাস, আমাদের স্বদেশের ধারণা, তা ক্রমশ ক্ষীণ হচ্ছে ক্ষমতাসীন শাসকের হাতে। গত এক দশক ধরে এই দেশ দেখছে, এই বাংলা দেখছে তর্জনীর আস্ফালন। রাজনীতিতে এক ভয়াবহ পরিবর্তন ঘটে চলেছে অবিরাম। সে পরিবর্তন প্রভাব ছড়াচ্ছে শিক্ষায়-সংস্কৃতিতে, অর্থনীতিতে, আমাদের সমাজজীবনের প্রতিটি ধারায়। হিন্দুত্ববাদ নামক রাজনৈতিক তত্ত্বের ওপর দাঁড়িয়ে যারা আমাদের মূলভিত্তিকে ছুঁড়ে ফেলতে চাইছে, ভারতের রাজনীতিতে সদম্ভে বিচরণ করছে, তাদের সবথেকে বড়ো সংগঠন আরএসএস। রাষ্ট্রের চরিত্রের গুণগত পরিবর্তন চায় বলেই, আরএসএস একটি 'রাজনৈতিক দল' না হলেও, বহু শাখা-প্রশাখায় বিস্তৃত একটি 'রাজনৈতিক সংগঠন' অবশ্যই। যার রাজনীতি জনজীবনের দুর্দশার চিত্রকেই যে শুধু আড়াল করতে চায় তা নয়, ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়িয়ে জনপরিসরে বিভাজন তৈরি করাই সে রাজনীতির মূল লক্ষ্য। বলাই বাহুল্য, বহুমুখী প্রতিরোধের সূচনাও এখানেই। দেশের এই পতন এবং তার বিপরীতে দেশ রক্ষার তাগিদই আজকের রাজনীতির চালচিত্র। সময়ের ওঠা-নামার প্রতিবেদন 'গণশক্তি'-র রোজনামচা। কিন্তু শুধু ঘটনার ধারাবিবরণীই তার একমাত্র বিষয় হতে পারে না, তারমধ্যে থেকে বেরিয়ে আসার পথ খোঁজাও আমাদের নিরন্তর অনুশীলন। এই প্রেক্ষিতেই 'গণশক্তি'-তে প্রকাশিত বিভিন্ন আঙ্গিকের প্রবন্ধ নিয়ে এই সংকলনের উদ্যোগ। বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলনের নেতা, অর্থনীতিবিদ, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, সাংবাদিক তাঁদের এই লেখাগুলিতে সমকালীন ভারতের ঘটনাবহুল ছবি তুলে ধরেছেন। ২০২২ ও ২০২৩ সালে 'গণশক্তি'-তে প্রকাশিত বেশ কিছু প্রবন্ধ বেছে নিয়ে এই সংকলনটি প্রকাশ করা হয়েছে। সময়ের চাহিদায় দেশ বাঁচানোর সংগ্রামে বইটি পাঠকদের সংগ্রামী মননে সামান্য হলেও সহায়তা করবে।
ইরফান হাবিব মার্কসবাদী ঐতিহাসিক হিসাবে বিশ্ববন্দিত। কিন্তু এই অভিধা ঐতিহাসিক ইরফান হাবিবের ইতিহাস চর্চার মৌলিকত্ব ও অভিনবত্বের সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা দেয় না। মার্কসবাদ ও সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী এই মানুষটি মার্কসবাদী ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রে যে বলিষ্ঠতা ও মৌলিকত্ব প্রদর্শন করেছেন, তাতে ভারতইতিহাস চর্চায় নিয়ে এল এক অভাবনীয় মাত্রা। প্রাচীন যুগ থেকে আধুনিক যুগের ভারতবর্ষের ইতিহাসের প্রায় সব ক্ষেত্রেই তাঁর অনুসন্ধানী দৃষ্টি পড়েছে। তার বস্তুনিষ্ঠ, তথ্যসমৃদ্ধ বিশ্লেষণের আলোয় মধ্যযুগের ভারত স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এ বিষয়ে তাঁর পিতা বিখ্যাত ঐতিহাসিক মহম্মদ হাবিবকেও তিনি ছাড়িয়ে গেছেন বলে মনে হয়। তাঁর The Agraian System of Mughal India ক্লাসিক পর্যায়ের ইতিহাস চর্চা। তিনি ১৯৩১ সালে উদারপন্থী-মুসলমান পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে মাত্র ২২ বছর বয়সে ইতিহাস বিভাগে লেকচারার পদে যোগ দেন। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পি এইচ ডি ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক পদ থেকে ১৯৯২ সালে অবসর নেন। এখনও তিনি ভারতব্যাপী গবেষকদের প্রেরণাদাতা ও সঠিক পথের দিশারি। তার নিজস্ব গবেষণা-গ্রন্থ, সম্পাদিত-গ্রন্থ এবং প্রবন্ধ কেবল সংখ্যার দিক থেকেই নয়, বিষয় বৈচিত্র্যে, গভীরতায় এবং মার্কসীয় ব্যাখ্যার অনন্যতায় অসাধারণ।