গুপ্ত কথা, গুপ্ত লিপি, গুপ্ত কান্ড, গপ্ত রহস্য, গুপ্ত প্রেম, ক্রমে সকলই ব্যক্ত হইয়াছে। কিন্তু আজ পর্য্যন্ত মনের কথা মনেই রহিয়াছে। মনের কথা অকপটে মুখে প্রকাশ কর বড়ই কঠিন। বিশেষ সংসারীর পক্ষে নানা বিঘ্ন, নানা ভয়, এমনকি জীবনের সংশয়। সংসাওে আমার স্থায়ী বসতি স্থান নাই। সম্পত্তি স্থান নাই। সম্পত্তি নাই, আত্মীয় নাই, স্বজন নাই, বুদ্ধি নাই। আপন বলিতে কেহই নাই। চক্ষু কাঁদে। মনের কান্নার সহিত একত্রে মিলিয়া মিশিয়া কাঁদে না- উপরি ভাবেই চক্ষে জল গড়াইতে থাকে আবার পরষ্পর তুমি ‘আমার’ আমি ‘তোমার’ বলিয়া প্রেমের হাট, মায়ার বাজার বসাইয়া দেই। সকলেই কি প্রেমের দোকনদারী করিতে জানিনা- ঠিকভাবে খরিদ বিক্রী করে মহাজনকে কিছু লাভ দেখাইতে পারি না- সকলই মুখে!! এখন বাকী রইল, ‘আমি’। কারণ ‘তুমি আমার আমি তোমার’। আমি কার কে, আমিই বা কে, সেই আমি- যাহার জন্যে কাঁদিবার একটি চক্ষুও নেই। আমি সেই আমি। কিন্তু আমি এমনই আজ যে একত্র এক দেহ এক প্রাণ হইয়া অনেকদিন কাটাইলাম। চক্ষুতে অন্ধকার ঘিরিল, কালকেশ ধবল হইয়া আসিল, জীবন শেষ, যাহা যাহা হইবার কথা, তাহা সকলই হইল, চিনিলাম না- চিনিতে পারিলাম না- আমি কে!
আমারই যখন আমিত্বে নানা গোল- তখন ‘আমি তোমার’ একথাটিও বোধ হয় মুখেরই কথা, -কথারই কথা। আমাতেও সন্দেহ- তোমাতেও সন্দেহ। আসলেই ভুল। আমিও আমার নহে, তুমিও তোমার নহ। কাজেই ‘আমার’ ‘তোমার’ কথাটাও কিছু নহে। আপন বলিতে আমার কেহ নাই। কার্য্য এবং ব্যবহারেই মায়া- সংসারময় স্বার্থেও অপছায়া।
২.
এই অসার, অপরিচিত, অস্থায়ী ‘আমি’ আমার ভাবনা চিন্তার কোনই কারণ নাই। সুতরাং মনের কথা অকপটে প্রকাশ করিতে বোধ হয় পারিব। সত্য মিথ্যা ভগবান জানেন, আর মা জানেন। কারণ শোনা কথাই পথিকের মনের কথা। সে কথার ইতি নাই। জীবনের ইতির সহিতেই কথার ইতি-আমার মনের শেষ কথা।
জলধির জলের ঘাত প্রতিঘাতেই স্তরের সৃষ্টি। সংসার সাগরেরও ঠিক তাহাই। সেই ভীষণ তরঙ্গের ঘাত প্রতিঘাতে যে সকল স্তরের সৃষ্টি হইয়াছে, তাহাই একে একে ভাঙ্গিয়া দেখাইব। আর মনের কথা শুনাইব!
পাঠক সমালোচনায় ভয় আমার নাই। কথা শুনাইয়া যাইব এইমাত্র কথা। তবে একটা কথা, যদি কাহার মনের কথার সহিত আমার মনের কথার কোন অংশ আঁকে জোঁকে, আকার প্রকাওে, ইঙ্গিতে আভাষে, ঠিক বেঠিক, মিল গরমিল বোধ হয়, তবে কিছু মনে করিবেন না, - কোন সন্দেহ করিবেন না। মার্জ্জনা প্রার্থনা করি, ভুলভ্রান্তি সকলেরই আছে।
আপনাদের
অনুগ্রহ প্রত্যাশী-উদাসীন পথিক।
উদাসীন পথিকের মনের কথা
প্রথম স্তর। প্রথম তরঙ্গ
নীল কুঠী
কুষ্টিয়ার বর্তমান রেলওয়ে ষ্টেশনের উত্তর সীমা গৌরী নদী, পূর্ব সীমা কালীগঙ্গা গৌরীর দক্ষিণ পার্শ্ব হইতে ছুটিয়া ক্রমে দক্ষিণ দিক বহিয়া কুমার নদে মিশিয়াছে। কালীগঙ্গার বাম তীওে শালঘর মুধয়ার নীল কুঠী। রেলওয়ে ষ্টেশন হইতে সাত মাইল ব্যবধান। বর্ষাকাল- নীল কাজ অরম্ভ, দিবারাত্র লোকজনের কোলাহল।
বেলা প্রায় ৮টা। কুলীরা বোঝা বোঝা “নীল শিটি” মাথায় করিয়া হউজের বাহিওে ফেলিতেছে, নীল পচা দুর্গন্ধময় জল, নাক মুখ বহিয়া বুকে পীঠে পড়িতেছে। অল্প পরিসর পরিধেয়খানি ভিজিয়া পায়ের পর্য্যন্ত নীল রঙ্গে রাঙ্গিয়া যাইতেছে। ছোট হউজের কুলীরা ব’ঠে হস্তে চক্রাকাওে দাঁড়াইয়া তালে তালে নীল পচা জল, মাই* (মন্থন) করিতেছে। জাঁতঘরে জ্বালানী মাল জাঁত হইতেছে। আপীস দালানে আমলাগণ আপন আপন কার্য্যে বসিয়া কাগজ কলমে মনের সহিত কথাবার্তা কহিতেছে। মে: টি, আই, কেনী শয়ন কক্ষেই আছেন। দ্বিতল হইতে নামেন নাই। প্রতিদিন ৭ টার সময় নীচে নামিয়া ডিহী দেখিতে গমণ করেন, ৮টা বাজিয়া যায়, নীচে আসিতেছেন না। কেফাতুল্লা দরওয়ান, সিঁড়ির সম্মুখে পায়চারী করিয়া খাড়া পাহারা দিতেছে। রাম ইয়াদ পাঁড়ে জমাদার ঢাল তরবার বাঁধা, দাড়ী দুই ফাঁক করা কপালে রক্ত চন্দনের ফোঁটা, আমীন, তাগাদগীর, কোড়া বরদারসহ বারান্দার সম্মুখে মনিবের আগমন অপেক্ষায় দাঁড়াইয়া আছে। নীলমণি মাহুত লাল বনাতের কুর্ভি পরিয়া, মাথায় লাল পাগড়ী বান্ধিয়া অংকুশ হস্তে প্যারীজান হস্তীর ঘাড়ের উপর বসিয়া সিঁড়ির দিকে তাকাইয়া রহিয়াছে। প্যারীজান শুঁড় দোলাইয়া কর্ণ নাড়িয়া পুচ্ছ হেলাইয়া বিরক্তিকর কীট পতঙ্গ সকল শরীর হইতে তাড়াইতেছে। জয়চাঁদ সইস, শ্বেতবর্ণ অয়লারের বাগডোর ধরিয়া খাড়া রহিয়াছে। সময় সময় চামর দ্বারা ঘোটক বরের গাত্র হইতে মক্ষিকা তাড়াইতেছে। তত্রাচ ঘরগতি “অয়লার” পুচ্ছ গুচ্ছ অনবরত নাড়িয়া হেযারবে সকলের দৃষ্টির আকর্ষণ করিতেছে। বেহারাগণ পাল্কী মাটিতে রাখিয়া ‘বেলা হইল’ আজ রোদ্রে মারা পড়িব’ ‘সাহেবের বুদ্ধি নাই’ বলে কার যেন পিতৃমাতৃ শ্রাদ্ধ করিতেছে। সঙ্গে সঙ্গে সময় যাইতেছে। সকলেই দেখিল কেফাতুল্লা পায়চারী রাখিয়া সেলাম বাজাইবার জন্য নম্র ভাবে দাঁড়াইল। দরওয়ানজীর ভাবে সকলেই বুঝিল যে সাহেব নীচে নামিতেছে, সকলেরই পূর্ব্বভাব পরিবর্তন। নূতন ভাব নম্র ও সতর্ক। বেহারাগণের মুখ বন্ধ, বেশীর ভাগ পাল্কী ঘাড়ে, কাম বাজাইতে খাড়া- প্রস্তুত। টি আই, কেনী পাইপ টানিতে টানিতে বেত হস্তে নীচে নামিলেন। সসব্যস্তে সকলেই ঘাড় নোয়াইয়া দস্তুরমত সেলাম বাজাইল। সামান্য চাকরের সেলামের প্রত্যুত্তর, প্রায়ই নাই, ইংরেজ আরও কড়া মেজাজ, সে দিক লক্ষ্য না থাকিবারই কথা। জয়চাঁদ সইসের দিকে বেত উঠাইয়া বলিলেন, ঘোরা লও। জয়চাঁদ ঘোড়া লইয়া নিকটে আসিল। কেনী আরোহণ করিলেন। আবার বন্দুক শব্দ উচ্চারণ করিতেই পীরবক্স শিকারী তাড়াতাড়ি বন্দুক তোজাদান লইয়া সাহেবের পশ্চাৎ পশ্চাৎ ছুটিল। আমীন, আগাদগীর, কোড়াবরদার চাকুরী বাজাইতে উর্দ্ধশ্বাসে দৌঁড়িতে লাগিল।
নীলমণি মাহুত চাই ধাৎ করিয়া প্যারীজানকে পিলখানায় লইয়া গেল। বেহারাগণ আজিকার মত রক্ষা পাইল। কিন্তু সর্দ্দার বেহারা মধু বলিতে লাগিল, “দেখ ত ভাই। বেটার বুদ্ধি! কথাটা আগে বল্লেই হইত। আজ ঘোড়ায় চড়িয়া ডিহী দেখিতে যাইব, হাতি পালকীর দরকার নাই।” মনিবের বুদ্ধি বিবেচনায় সাত প্রকার ত্রুটি দেখাইয়া আপীস ঘরের বারান্দায় পালকী রাখিয়া মধু সদলে বাসায় চলিয়া গেল।
টি, আই, কেনীর মনের কথা আগে কেহ জানিতে পারিত না। কোন্দিকে নীল দেখিতে যাইবেন, সে কথা কাহারও জানিবার সাধ্য ছিল না। কুঠীর চতুর্দ্দিকেই নীল জমি। যে দিকে তাঁহার ইচ্ছা হইত, সেই দিকেই তিনি যাইতেন। আমীন, খলাসীরা তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ ছুটিতে। একদিন যে দিকে যাইতেন, পরদিন আর সেদিকে যাইতেন না। - একথা সকলেই জানিত। আজ তিনদিন ক্রমাগত উত্তর দিকেই যাইতেছেন। কুঠীর উত্তর দিকে দমদমা গ্রাম। টি, আই, কেনী দমদমা গ্রামের মধ্যে যাইয়া পথ ভুলিয়া অন্য পথে যান। তাঁহার বহুকালের চেনা পথ কেন ভুল হয়, তিনিই জানেন। ঘুরিয়া ঘুরিয়া একটি গৃহস্থের কুঁড়েঘরের দিকে লক্ষ্য করেন। গ্রাম্য পথ। গ্রাম্য লোক, সাহেব দেখিলেই ভয় পায়। সাহেব বাহির হইয়াছে গুনিলে যে যেখানে থাকে সে সেইখানেই, গাছের আড়ালে কি পথের ধাওে ফুকায়-ঝাড় জঙ্গলে মাথা দেয়, একেবাওে সরিয়া যাএত না পরিলে কাঁপিতে কাঁপিতে সেলাম বাজাইয়া জোর পায়ে সরিয়া পড়ে। গ্রাম্য স্ত্রীলোকেরা সাহেবের নাম শুনিলেই ঘরের দোর আঁটিয়া কেহ মাচার নীচে, কেহ ঘরের আড়ালে থাকিয়া বিলাতী রূপ দেখিয়া চক্ষু জুড়ায়। কেনী একদিনে এক পথে কখনই যাওয়া আসা করিতেন না। আজ তিনদিন হোতে তাঁহার সে নিয়ম ভঙ্গ হইয়াছে। প্রতিদিনই দমদমা গ্রামের মধ্যে দিয়া যাওয়া আসা করেন। একজন দুঃখী প্রজার বাড়ীর নিকট বিনাপরাধে ঘোড়ার উপর চাবুক সৈ করেন- কিন্তু অশ্বের বাগডোরে গতিরোধ সংকেত। অয়লারের মহা বিপদ। পিছাড়া, সিকপা যতরকমের বজ্জতি সে জানিত, তাহা বাধ্য হইয়া করিতে বাধ্য হইত। খুরের খট্খট্ চাবুকের পটাপট, বিলাতী কন্ঠের হুটপাট শব্দ শুনিয়া অনেকেই সাহেবের ঘোড়ার কান্ডকারখানা ছুপানি পাতিয়া দেখিত। কেনীর সাদা চক্ষুও চারিদিকে অনবরত ঘুরিয়া কি যেন দেখিত। -চক্ষু যাহাকে দেখিতে চাহে, তাহাকে দেখিতে পায় না। প্রথমদিন যেখানে ঘোড়া দাঁড়াইয়াছিল, আজও সেই স্থানে দাঁড়াইল। সিকপা, পিছড়া ঝাড়া, কিছুই বাকী রহিল না। পরীবকস প্রভৃতি যাহারা কিছু পিছনে পড়িয়াছিল তাহারা আসিয়া জুটিল। ঘোড়া আর সোজা ভাবে চলে না। অনেক গৃহস্থেও পরিবার ঘরের বেড়া ছিদ্র করিয়া ঘোড়া দেখিতে লাগিল। কেনী বাহাদুরও আড় নয়নে চক্ষের কাজ করিতে লাগিলেন। কিন্তু তিনি যে মুখ দেখিবার জন্য নিরপরাধ দেড় টাকা দামের ঘোড়াটি নষ্ট করিতে উদ্যত, আজ সে মুখ তাঁহার পাপ চক্ষে পড়িল না। সাহেব অশ্ব হইতে নামিয়া স্নেহ বসে অশ্বগাত্রে হাত বুলাইয়া অনেক দেলাসা দিলেন। কিন্তু সে সময় তাহার চক্ষুর কার্য্য ভুলে নাই। সেই চক্ষু, সেই দর্শন, সেই আশা। ঘোড়া সহিসের হস্তে অর্পিত হইল। পীরবকসের নিকট হইতে বন্দুক লইয়া কেনী জিজ্ঞাসা করিলেন, “বন্দুক ভরা আছে?”
পীরবকস জোড়াহাতে বলিল, “হুজুর আমি ভরিয়া আনিয়াছি।”
কেনী বন্দুক লইয়া একটা গ্রাম্য ময়না পাখীর প্রতি লক্ষ্য করিলেন। সকলেই বলিল, “হুজুর ও পোষা পাখী। হুজুরের চাকর জকি গাড়োয়ানের ময়না পাখী, পোষ মানিয়েছে, বুলিও ধরিয়াছে।”
কেনী বলিলেন, “জকি গাড়োয়ান কে?”
একে বলিতে দশজনে বলিয়া উঠিল, “হুজুরেরই চাকর-গরুর গাড়ীর কাজ করে। হুজুরের বহুদিনের চাকর, এ বাড়ীঘর দোর সকলি হুজুরের, হুজুরই সকলের মালিক।”
সাহেব অন্যদিকে ফিরিয়া একটা ফাঁকা আওয়াজ করিলেন। ময়না জকির ঘরের মধ্যে পালাইল। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা হাউ মাউ করিয়া কাঁদিয়া উঠিল। কেনী পীরবকসের হস্তে বন্দুক দিয়া অশ্বে আরোহণ করিলেন। অশ্ব শান্তভাবে চলিতে লাগিল। নীল জমি দেখার আজিকার মত এই পর্যন্ত শেষ হইল। কিন্তু অকারণে দুই তিনজন কুলীকে চাবুক সই করিয়া কুঠীরদিকে ফিরিলেন। আপীস ঘরের সম্মুখে আসিয়া হরনাথ শ্রী মিশ্রী (নায়েব), শম্ভুচরণ সানাল (দেওয়ান) প্রভৃতিকে কটু ভাষায় কয়েকটি কথা কহিয়া গরম ভাবে বলিলেন, “যাহা যাহা বলিয়াছিলাম, তাহার কি করিয়াছ? সাওতার মীর সাহেবের নিকট পত্র লিখা হইয়াছে?”
হরনাথ বলিলেন-
“ধর্ম্মাবতার কোন বিষয়ে ত্রুটি নাই। পত্র লিখা হইয়াছে, কেবল হুজুরের সহি বাকী।”
কেনী অশ্ব হইতে না নামিতেই তিন চারিজন আমলা ব্যস্ত সহকাওে ঘোড়া ধরিলেন। “কৈ! সে পত্র কৈ?”
সান্যাল মহাশয় পত্র হাতে করিয়াই দাঁড়াইয়াছিলেন। আপীস ঘরের সম্মুখেই পত্র সহি হইল, তখনি সাঁওতায় লোক রওনা হইল।
কেনী বলিলেন-
“জকি গাড়োয়ানের বাড়ীতে একটী পোষ্য পাখী আছে, আমি সেই পাখীটা চাই।”
এইকথা বলিয়াই বাস ঘরের দিকে যাইতে লাগিলেন। কিছু দূর যাইয়া পুনরায় ফিরিয়া বলিলেন, “জকি যে দাম চাহে, সেই দামই দিব। সকের জিনিস জবরানে লইব না। তোমারও জবরদস্তি করিয়া আনিও না।”
এই কয়েকটী কথা যেন হৃদয় হইতে কহিয়া চলিয়া গেলেন।