নিতান্ত পল্লিগ্রামে আমার জন্ম ও বেড়ে উঠা! মেধা বিকাশের ন্যূনতম গিগাবাইট (সুযোগ) না থাকার পরেও চলতো নিজ উদ্যেগে নতুন কিছু করা! কাঁচা মাটি মাড়িয়ে লুঙ্গি খুলে পুকুরে সাঁতার ও দৌড়ে লাফঝাঁপ করা! এমনকি ঘণ্টার পর ঘণ্টা পুকুরের পানি ঘোলাটে করে চোখ লাল করে ঘরে গিয়ে শলার ঝাড়ুর মাইর খাওয়া আমাদের শৈশবকে দুরন্ত গতি এনে দিতো!
বাড়ির পূর্ব পাশে বিশাল খাল বয়ে গেছে উত্তর দিকে! সন্দ্বীপ টাউন সাঁওতাল খাল থেকে এ খালের উৎপত্তি!
সকালে মক্তবের ছুটির পর তিনঘণ্টা ছিল স্কুল যাওয়ার প্রস্তুতির সময়! এই তিনঘণ্টায় চলতো বিভিন্ন অভিযান!
বাড়িতে সমবয়সি ভাই ও কিছু সিনিয়র জুনিয়র চাচাতো জ্যাঠাতো ভাই একত্রিত হয়ে নতুন নতুন আ্যাডভান্সর তৈয়ার করতাম! কখনো ঘুড়ি উড়ানো, লাটিম খেলা, মার্বেল খেলা, মাটির চাড়া দিয়ে তাস খেলা, বিকেলে বাড়ির উঠানে ফুটবল, ব্যাডমিন্টন ও সাইকেল চালানো শিখা আমাদের শৈশবকে করেছে স্মরণীয়! কখনো কখনো দলবেঁধে লুঙ্গি খুলে দিগম্বর হয়ে খালে নেমে পড়তাম মাছ ধরতে! আবার কখনো কখনো স্কুল বন্ধের সময় দলবেঁধে নদীতে যেতাম সাঁতার কাটতে! শৈশবের দুরন্তপনার দিনগুলোতে কঠিন শাস্তির মুখোমুখি হতে হতো সবসময়! তারপরেও ননস্টপ চলতো সব আয়োজন!
এত কিছুর পরেও সকালবেলার মক্তব ও স্কুলে যাওয়া বাধ্যতামূলক ছিল সবার! পড়াশোনার ব্যাপারে অভিভাবকদের আপস না থাকায় সবাই উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করে স্ব স্ব স্থানে বর্তমানে প্রতিষ্ঠিত!
২
পল্লির শৈশবের কাদামাটি, জীবনের গল্পকে বিষাদে আচ্ছন্ন করেছে আমায়! চিত্তবিনোদনের অন্যতম সঙ্গী ছিল তিন ব্র্যান্ডের রেডিও! সাদা-কালো টেলিভিশন ছিল মরহুম আছাদুল হক চৌধুরী সাহেব মিয়াঁর ঘরে! রাতে স্কুলের পড়া ও হোমওয়ার্ক কমপ্লিট করে রবিবারের একঘণ্টার নাটক কিংবা ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান দেখতে যেতাম আম্মার অনুমতি নিয়ে! অনেক সময় অনুমতি না মিললে তারপরও যেতাম! বিনানুমতিতে যাওয়ার খেসারত দিতে হতো শলার ঝাড়ুর মাইর কিংবা সকালের মক্তবের হুজুরের কুমড়া চেঙ্গি!
রেডিও তে নিয়মিত শুনতাম বিবিসি বাংলা ও ভয়েস অফ আমেরিকা বাংলা বিভাগের অনুষ্ঠান মালা! আমি নিয়মিত পত্রমিতালি করতাম এই দুটি সংবাদ মাধ্যমে! চিঠিপত্রের ও সাহিত্যে আসরে আমার কচি হাতের চিঠি তারা পড়েও প্রাপ্তি নিশ্চিত করতো!
ভয়েস অফ আমেরিকার সান্ধ্যকালীন অনুষ্ঠান “মহিলা অঙ্গনে” "আমার একটা চিঠি পড়ে সঞ্চালক মাসুমা খাতুন আবেগ ধরে রাখতে পারেননি! রোকেয়া হায়দার ও জিয়াউর রহমান আমাকে সান্ত¦না দিয়ে উপহার পাঠান সন্দ্বীপের ঠিকানায়!
চিঠির ট্রপিক ছিল গ্রাম বাংলায় মহিলাদের নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিত করতে বিশেষ অনুরোধ!
আমার জীবনে ঘটে যাওয়া গল্প...
আমার জন্মের পূর্বে বড়ো আপুর বিয়ে হয়ে যায়! মেজো আপু তার পড়াশোনার পাশাপাশি আম্মাকে গৃহস্থালির কাজে সাহায্য করতেন! আমার জন্মের পর আম্মা একেবারে অসুস্থ! আলসার ও নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত!
আমাকে দেখবার করে মেজো আপু! কাচের কলাপিডারে করে গরুর দুধ ও চালের পায়েস, খিচুড়ি রান্না করে খাওয়ানো উনি করেন! আমার হাগুমুতু পরিষ্কার করে নতুন শার্টপ্যান্ট তিনি পরিয়ে দিতেন! আমি মেজো আপুর সাথে থাকতে অভ্যস্থ হয়ে গেলাম!
একটু বড়ো হলে আম্মাকে কোন কিছুর জন্য বিরক্ত করলে আম্মা বলতেন, আমি মরে গেলে আম্মা কাকে ডাকবি? আমি জবাব দিতাম, মেজো আপুকে! আমি জানতাম না যে বোনকে আম্মা ডাকা যায় না!
একদিন মেজো আপুর বিয়ে হলো অনেক বড়ো বাড়িতে!
আনন্দে আহ্লাদে চলার পর খবর আসলো মেজো আপু মা হবে! সবার মাঝে আনন্দের খবর হলেও আপুর গাইনি জটিলতা ছিল! সন্দ্বীপের কোথাও গাইনি চিকিৎসক নেই! হাতেগোনা কয়েকজন এমবিবিএস ডাক্তার ছিল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে! যাতায়াতের অসুবিধা ও মাটির কাঁচা রাস্তার জন্য ডাক্তার রোগীর বাড়িতে আসতে অনিচ্ছুক! চিকিৎসা সেবার ভরসাস্থল পল্লি চিকিৎসক ও হুজুরের পানি পড়া!
একদিন রাতের শেষ প্রহরে মেজো আপুর ডেলিভারি পেইন শুরু হলো! গ্রাম্য কবিরাজের চিকিৎসা ও হুজুরের পানি পড়া খেয়ে সবার সম্মুখে দোয়া পড়তে পড়তে চলে গেলেন অনন্তকালের যাত্রী হয়ে!
আমার কচি মনে যে ঢেউ লেগেছিল তা আমি আজও বহন করি!